Boiraag Publication - বইরাগ পাবলিকেশন

Boiraag Publication - বইরাগ পাবলিকেশনBoiraag Publication - বইরাগ পাবলিকেশনBoiraag Publication - বইরাগ পাবলিকেশন
  • Home
  • বাংলা ইবুক
    • Categories
    • Free eBooks
  • collaborations
  • English e-books
  • e-Magazine
  • Contact & more
    • Contact Us
    • Publish With Us
    • About Us
    • View us on Youtube
    • Announcements
  • More
    • Home
    • বাংলা ইবুক
      • Categories
      • Free eBooks
    • collaborations
    • English e-books
    • e-Magazine
    • Contact & more
      • Contact Us
      • Publish With Us
      • About Us
      • View us on Youtube
      • Announcements

Boiraag Publication - বইরাগ পাবলিকেশন

Boiraag Publication - বইরাগ পাবলিকেশনBoiraag Publication - বইরাগ পাবলিকেশনBoiraag Publication - বইরাগ পাবলিকেশন
  • Home
  • বাংলা ইবুক
    • Categories
    • Free eBooks
  • collaborations
  • English e-books
  • e-Magazine
  • Contact & more
    • Contact Us
    • Publish With Us
    • About Us
    • View us on Youtube
    • Announcements

কেদারনাথ- অপর্ণা চৌধুরী

পর্ব ১

(১)

বাবা অধীর,

অনেকদিন তোমাদের কোন খবর পাইনা। তুমি বউমা আর অনু দিদি কেমন আছ? তোমাদের বড্ড দেখতে ইচ্ছা করে। তোমাকে শেষ দেখেছি সেই তোমার বিয়ের সময়। তখনও মেজদি বেঁচে ছিলেন। তারপর শুনলাম তোমরা দেশের বাড়ী এসেছিলে, সেও বছর দুয়েক হল। তোমার মেশোমশাইয়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। ডাক্তারবাবু বলেছেন এই ভাবেই যতদিন চলে। একবার যদি আমার এখানে তোমরা আসো তো আমি অনু দিদিকে চোখের দেখা দেখতে পাই। আমি আর কতদিনই বা বাঁচবো । 

আশীর্বাদান্তে

তোমার ফুলমাসীমা 

এলাহাবাদ

১০ নভেম্বর ২০১২ 


এয়ারমেলের নীল খামটা হাতে নিয়ে অনুষ্কার বাবা অধীরবাবু চুপ করে লিভিং রুমের সোফাতে বসে ছিলেন। আজ শুক্রবার। বিকালের ডাকে চিঠিটা এসেছে। অনুষ্কা ওর মা নীলিমার সাথে স্কুলের পরে শপিং করতে গিয়েছিল। এখানে এখন ক্রিসমাস সেল শুরু হয়ে গেছে। নীলিমা গাড়ীটা গ্যারাজে ঢুকিয়ে শপিং এর ব্যাগগুলো বার করে অনুষ্কাকে কয়েকটা ব্যাগ দিলেন আর নিজে বাকিগুলো নিলেন। খুব ভালো ডিল পাওয়া গেছে আজ। দুজনেই সেই আলোচনাতে ব্যস্ত। এক্ষুনি জিনিষগুলো নিয়ে গিয়ে বাবাকে দেখাতে হবে। অনুষ্কার আর তর সইছেনা। দুজনে গ্যারাজ লক করে কিচেনের মধ্যে দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। লিভিং রুমে পৌঁছে অধীরকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে একটু থমকে গেলো দুজন। 


নীলিমা ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করলেন, “ কি হয়েছে?”

অধীর কোন কথা না বলে চিঠিটা এগিয়ে দিলেন নীলিমার দিকে। নীলিমাও এক নিঃশ্বাসে চিঠিটা পড়ে, চুপ করে সোফায় অধীরের পাশে বসে পড়লেন। 


অনুষ্কা হতভম্ব হয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল তারপর ধীরে ধীরে বলল,” Will anybody tell me what’s happening? Who has sent you this letter? আজকাল তো কেউ letter পাঠায় না, সবাই email করে।“    

 

নীলিমা অনুষ্কাকে ডেকে তাঁর পাশে বসালেন তারপর বললেন,” তোমার বাবার এক মাসীমা আছেন। উনি ইন্ডিয়ার এলাহাবাদ শহরে থাকেন। ওনার চিঠি এসেছে। ওনার নিজের কোন ছেলেমেয়ে নেই , তোমার বাবাকেই নিজের ছেলে বলে মনে করেন। সেই মাসীমা তোমাকে একবার দেখতে চান।“


অনুষ্কা লাফিয়ে উঠলো, “ Oh great! Let’s go and meet her then.  আমারও তো ছুটি শুরু হচ্ছে। India here we come again.” বলেই তড়াক করে একটা লাফ মারল সে। ওর উৎসাহ দেখে অধীর আর নীলিমা একসঙ্গে হেসে উঠলেন।


“ I still cherish my visit to দেশের বাড়ী...। আর ofcourse remember শ্রীমতী সন্ধ্যারানী দেবী।“  অনুষ্কার চোখটা ছলছল করে উঠলো। 


অধীর পরিবেশটা হাল্কা করতে তাড়াতাড়ি বললেন, “ দাঁড়া দাঁড়া এতো তাড়াতাড়ি টিকিট পাওয়া, ছুটি পাওয়া বাকি সব ব্যবস্থা করা। কি জানি সম্ভব হবে কিনা?”


“Where there's a will there's a way”, চেঁচিয়ে উঠলো অনুষ্কা।

মা বাবা একসাথে বলে উঠলেন , “ ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে।“

“বাবা, চলোনা দেখি টিকিট পাওয়া যায় কিনা?” অনুষ্কা আবার ফুল মুডে।


অধীর নিজের ল্যাপটপ খুলে বসলেন। ডিসেম্বরের টিকিট আছে, মাত্র পাঁচটা। অধীর নিজের বসকে ফোন করলেন। টিকিট কাটার আগে ছুটির ব্যবস্থাটা করা দরকার। বসের সঙ্গে কথা শেষ করে ফোনটা রেখে মুখটা তুলেই অধীর দেখলেন দু জোড়া গোল গোল চোখ ওনার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। উনি হেসে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতেই মা মেয়ে একসাথে “ইয়ে “ বলে চেঁচিয়ে উঠলো।  


প্রথমে ওয়াশিংটন থেকে নিউদিল্লি তারপর সেখান থেকে ডোমেস্টিক ফ্লাইটে এলাহাবাদ। অধীর সব টিকিটগুলো বুক করে ল্যাপটপটা শাট-ডাউন করে দিলেন। আর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ইন্ডিয়া যাওয়া। এতো দেরিতে ঠিক করেও যে টিকিট পেয়েছেন এটাই আশ্চর্য লাগছে। এর পরের কাজ হল ফুলমাসীমাকে আই এস ডি করে জানানো।  দেখলেন নীলিমা খাতা পেন নিয়ে লিস্ট করতে বসে গেছে। জিজ্ঞাসা করলেন, “ কি এতো লিখছ?”


“ আরে কার জন্য কি নিয়ে যাব, সব লিস্ট করছি, কাল গিয়ে কিনে আনব। আচ্ছা মাসিমার জন্য যদি একটা মিক্সার গ্রাইন্ডার নিয়ে যাই কেমন হয় বলতো?”

অধীর ভেবে বললেন,” পুরনো দিনের লোক, জানিনা ব্যবহার করবেন কিনা? তুমি শীতের জামা বা পা ঢাকা নরম চটি নিতে পার। এলাহাবাদে কিন্তু খুব শীত পড়ে।” 

“ঠিক আছে। “


“আমাদেরও শীতের জামাকাপড় গুছিয়ে নিও, ওখানে কিন্তু এখানকার মতন সেন্ট্রাল হিটিং নেই।“

“হুম!” চিন্তিত ভাবে উত্তর দিলো নীলিমা।

এলাহাবাদে ফোন করলেন অধীর,” আমরা আসছি পনেরো তারিখে। তোমার জন্য কি আনব বল।“


ওপার থেকে উচ্ছ্বসিত উত্তর,” তোরা আসছিস এই যথেষ্ট আমার আর কিচ্ছু চাই না। কিন্তু এই কদিন অনুদিদি আমার সাথে থাকবে। তোরা কিছু বলতে পারবি না। এই আমি এখন থেকে বলে দিলুম।“


“ আচ্ছা বাবা আচ্ছা। তোমার নাতনি তুমি যা খুশি কোরো।“

ফোনটা রেখে দিয়ে অধীর বললেন,” জানো নীলিমা, মাসিমা যে কি খুশি হয়েছেন কি বলবো!“ 

“তাতো জানি, কিন্তু এখন সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে ঠিকঠাক পৌঁছতে পারলে তবে হয়।“

“তুমি টেনশন কর না, সব হয়ে যাবে, ম্যায় হু না!”

”সেটাই তো চিন্তা!“ নীলিমার সহাস্য উত্তর


(২)

অনুষ্কা ওর ফুলঠাম্মিকে দেবার জন্যে একটা খুব সুন্দর কার্ড বানিয়েছে। ও নিজের তরফ থেকে কিছু দিতে চায় ফুলঠাম্মিকে। 

জিনিষপত্র কেনাকাটা গোছানো ইত্যাদি করতে করতে মাঝের কটা দিন যে কিভাবে কেটে গেলো, তা ওরা বুঝতেই পারলো  না। 

দেখতে দেখতে যাবার দিন এসে গেল। প্লেনে ওদের বেশীরভাগ সহযাত্রীই ভারতীয়।  অনুষ্কা সব যাত্রীদের লক্ষ্য করছিল। কত মজার লোকজন। একজন লোক এতো মোটা যে তার সীট বেল্টটা ফিটই করলো না। এয়ারহোস্টেস এসে তাকে একটা এক্সট্রা বেল্ট দিলো। একজন আবার পরচুলা পরে এসেছেন। তার ব্যাগটা ওভার হেড লকারে রাখতে গিয়ে ব্যাগের  স্ট্র্যাপটা ওনার চুলে আটকে গিয়ে চুলটা খুলে আসলো। উনি তাড়াতাড়ি এদিক ওদিক তাকিয়ে চুলটা আবার পরে নিলেন। 

প্লেনে আর সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটে নি। বাকি সময়টা অনুষ্কা ওর আইপ্যাডে বই পড়ে আর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলো।  


এলাহাবাদ এয়ারপোর্ট থেকে প্রি-পেইড ট্যাক্সি নিয়ে ওরা পৌঁছে গেলো ফুলঠাম্মির বাড়ীতে। ওনাদের বাড়িটা এলাহাবাদের একটি পুরানো অঞ্চলে। অনুষ্কা ওর বাবার মুখে এলাহাবাদের যে রকম বর্ণনা শুনেছিল তাঁর সঙ্গে এই এলাহাবাদের খুব একটা মিল পেলোনা। বরং সরু সরু রাস্তা আর ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ীগুলো দেখে ওর বেশ ঘিঞ্জিই লাগলো। বাড়ির সামনের গলিতে ট্যাক্সি ঢুকলো না, তাই গলির মুখটায় নেমে সুটকেসগুলো টেনে নিয়ে একটা কাঠের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। 


বাবা খট খট করে কড়া নাড়লেন। একটু বাদে একটি বছর দশেকের ছেলে এসে দরজাটা খুলে দিলো আর হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলো,” কৌন চাহিয়ে?”

অধীর বললেন “ বোলো আম্রিকা সে মেহমান আয়া।“ 

ছেলেটা হেসে বলল,” হাঁ হাঁ আসুন।“ তারপরই চিৎকার করে বলে উঠলো ,” দাদী!  উওলোগ আ গয়ে।“ 


অনুষ্কা নিজের সুটকেস সামলে বাড়ির ভিতর ঢুকে একেবারে অবাক হয়ে গেলো। ওই সরু গলি আর ছোট কাঠের দরজা দেখে ওর ধারণা হয়েছিল যে বাড়ীটা নিশ্চয়ই খুব ছোট, অন্ধকার আর বুকচাপা হবে। দরজা দিয়ে ঢুকে প্রথমে একটা চৌকো খোলা উঠোন, প্রায় ৫০ ফুট বাই ৪০ ফুট। দরজার বাঁ দিকে দেয়াল ধরে সারি দিয়ে বাসন মাজার জায়গা, কল ঘর, রান্নাঘর। ডান দিকে সাইকেল রাখার জায়গা, কয়লার ঘর, গুদাম ঘর। তারপর ইংরাজির “C”  অক্ষরের মত করে ঘরগুলো পরপর সাজানো। নিচে পাঁচটা আর দোতলায় চারটে ঘর। দোতলার সব ঘরগুলোর সামনে ঘোরানো ঝুলবারান্দা। 

পরে অনুষ্কা জেনেছিল যে, যে দরজা দিয়ে ওরা ঢুকেছিল সেটা খিড়কির দরজা। বাড়িটা দু-মহলা। এটা অন্দরমহল। উঠোনের অন্য পাশ দিয়ে একটা দরজা আছে যেটা দিয়ে বাহির-মহলে যাওয়া যায়। বাহির-মহলটা আরও সুন্দর, তার সামনে একটা বাগান আর লোহার বড় গেট আছে। কিন্তু সেই মহলটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে বলে ওরা পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছে।    


ছেলেটির হাঁকডাক শুনে একজন ছোটোখাটো, গোলগাল, বয়স্ক মহিলা, প্রায় ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলেন রান্না ঘর থেকে। ওনার পরনে লাল-পাড় সাদা শাড়ি, মাথার বেশীরভাগ চুল পাকা। ওরা জিনিষপত্র নিয়ে আঙিনায় দাঁড়িয়ে। উনি আসতেই বাবা ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। আর উনি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। তারপর অনুষ্কা আর তার মায়ের পালা। 

সকলকে উনি খুব আদর করে একতলার একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটা খুব বড় আর পুরানো দিনের আসবাব দিয়ে সাজানো। অনুষ্কা দেখলো ঘরের দেয়ালে ছোট ছোট গর্ত মত আছে। বাবা বললেন ওগুলো ‘কুলুঙ্গি’। আগে যখন ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না তখন ওর মধ্যে প্রদীপ জ্বেলে ঘর আলো করা হত।


“ মাসিমা এই ছেলেটি কে?” জিজ্ঞাসা করলেন আধীর।

“ ও ভরত। আমাদের বাড়ির পাশের বস্তিতে থাকে। স্কুল থেকে ফিরে সারাদিন আমার এখানে থাকে, আমার হাতে হাতে কাজ করে দেয়।  এখানেই খাওয়া দাওয়া করে। যখন কাজ থাকে না তখন বসে পড়াশোনা করে, ছাদে ঘোরে, ঘুড়ি ওড়ায়। আমারও ভালো লাগে। “ বললেন ফুলমাসীমা। 

“আমি তোমায় ফুলঠাম্মি বলে ডাকি?” জিজ্ঞাসা করলো অনুষ্কা।

“আচ্ছা দিদি তাই ডেকো। তোমরা এখন হাতমুখ ধুয়ে নাও তারপর চা জল খেয়ে দাদুর সাথে দেখা করতে যাবে’খন। কলঘরে জল দেওয়া আছে। “ বলে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।


হাত মুখ ধুয়ে ওরা সবাই রান্নাঘরের পাশে খাবারঘরে গেলো।  টেবিল এর উপর কাঁসার বাসনে খাবার দেওয়া হয়েছে। আলু চচ্চড়ি, আটার লুচি আর সুজির হালুয়া। ওরা পেট ভরে খেল। খেতে খেতে অনেক গল্প হল। 

খাওয়ার পর ওরা গেলো ফুলদাদুর সাথে দেখা করতে। ফুল-দাদু দোতলায় থাকেন। বেশি ওঠা হাঁটা করতে পারেন না। সবাই ওনার ঘরে ঢুকতেই উনি বিছানার ওপর উঠে বসলেন। দেখে বোঝাই গেলো যে উনি অনেকক্ষণ ধরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সবাই ওনাকে প্রণাম করলো। তারপর নীলিমা ওনাকে ওনার জন্য আনা সোয়েটার, মাফলার আর মোজা দিলেন। 


জিনিষগুলো দেখে উনি বাচ্ছাদের মত খুশি হলেন। মাফলারটা সঙ্গে সঙ্গে গলায় জড়িয়ে নিয়ে, বললেন, “ আঃ! কি আরাম। দেখ কি নরম!  ও দেশের জিনিষের কোয়ালিটিই আলাদা।“ তারপর ফুলঠাম্মিকে বললেন,” এই সোয়েটার আর মোজাটা তুলে রেখে দাও। কোন ভালো দিনে পরবো।“ 

আধীর আপত্তির স্বরে বলে উঠলেন ,” তুলে রেখে দেবেন না, পরুন!“

উনি হেসে বললেন,” নিশ্চয়ই পরবো , এই তো সামনেই নতুন বছর, তখন পরবো।“

অনুষ্কা ফুলঠাম্মিকে ওর বানানো কার্ডটা দিলো। ঠাম্মি কার্ডটা যত্ন করে তাকে তুলে রেখে দিলেন। বললেন,” এটা আমার পাওয়া সব চাইতে ভালো উপহার।“ 


দুপুরবেলা খাবার পর অনুষ্কা ভরতের সাথে বাড়ী দেখতে বেরোল। বাগানের টগরগাছে ভরত পাখি ধরার জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছিল। ফাঁদটা আর কিছুই না খানিকটা সুতো গাছের ডাল পাতার মধ্যে ফেলে রাখা। পাখী যখন গাছে বসে তখন ওই সুতোটা ওদের পায়ে আর পাখায় জড়িয়ে যায়। অনুষ্কাকে নিয়ে গিয়ে দেখাল ভরত। সেই ফাঁদে একটা চড়াইপাখির বাচ্চা ধরা পড়েছিল। ভরত খুব সাবধানে সেই পাখীটাকে সুতো থেকে ছাড়িয়ে এনে অনুষ্কার হাতে দিলো। অনুষ্কা কখনও জ্যান্ত পাখি হাতে ধরেনি। 

ভরত বলল ,” কসকে পকড়না দিদি নাহি তো উড় জায়েগি।“ বলতে বলতেই পাখিটা খচমচ করে নড়ে উঠলো অনুষ্কার হাতের মধ্যে আর অনুষ্কা চমকে গিয়ে হাতটা খুলে দিলো আর সঙ্গে সঙ্গে পাখিটা উড়ে চলে গেলো। 

আর ভরতের কি হাসি, “ দিদি ডর গয়ি, ডর গয়ি!”


ভরতের সঙ্গে অনুষ্কার খুব ভাব হয়ে গেছে। ও অনুষ্কাকে ছাদে নিয়ে গেলো। ছাদটা খুব সুন্দর, সেখান থেকে যমুনা দেখা যায়। কিন্তু অনুষ্কার সবচাইতে ভালো লাগলো চিলের ঘরটা। সেই ঘরটা ভর্তি পুরনো জিনিষপত্র আর একটা কাঁচের আলমারি ভর্তি পুরনো বই। অনুষ্কা আলমারিটা খুলে বইগুলো একটা একটা করে দেখতে লাগলো। বেশির ভাগ বই-ই হিন্দিতে লেখা। কোন কোন বই এর মলাট নেই, পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, হাত দিয়ে চাপ দিলে ভেঙ্গে যাচ্ছে। অনুষ্কা খুব সাবধানে বইগুলোকে বার করে একটা টেবিলের উপর রাখতে লাগলো। তাকের কোনের দিকে একটা শেক্সপিয়ার সমগ্র দেখে ও খুব উৎসাহিত হয়ে পড়লো। অবশেষে একটা ইংলিশ বই পাওয়া গেছে! বইটা বেশ ভারী। ভরতের অবশ্য বইপত্রে বেশী উৎসাহ ছিল না তাই ও ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।


“ এই ভরত একবার এদিকে আয়! এই বইটা পেড়ে দে তো!” ডাকল অনুষ্কা।

ভরত এসে একটা টুলে চড়ে কোনরকমে টেনে বইটাকে বার করতেই তার নিচে থেকে একটা লম্বা মত লাল কাপড়ে জড়ানো জিনিষ নিচে পড়ে গেলো। অনুষ্কা জিনিষটা মাটি থেকে তুলে কাপড়টা ধীরে ধীরে খুলে দেখল ভিতরে দুটো কাঠের পাটাতনের মাঝে পাতলা পাতলা কাগজের স্ট্রিপ রয়েছে। যার উপর কিছু লেখা আছে। ও ভাষাটা পড়তে পারলো না। 

“ইয়ে ক্যা হ্যাঁয় দিদি।“

“কি জানি? বাবা বলতে পারবে। চল বাবাকে দেখাই। ” 


সেটিকে আবার আগের মত লাল কাপড়টায় জড়িয়ে ও নিচে নিয়ে এলো। নিচে এসে দেখলো মা, বাবা আর ফুলঠাম্মি চা খেতে খেতে গল্প করছেন। ওদের দেখেই ফুলঠাম্মি বললেন ,” আয় কিছু খেয়ে নে। জানকী ওদের একটু দুধ আর পেঁড়া দে তো।“ 

“ ও খাওয়া পরে হবে। শোন না ঠাম্মি, উপরের চিলেকোঠায় না আমি একটা জিনিষ খুঁজে পেয়েছি, এই দেখ।“ , বলে সেটা বার করে দেখাল অনুষ্কা। 

“ এটা আবার কি রে?” 

“ দেখি দেখি...... ও বাবা! এতো খুব পুরনো একটা পুঁথি! সংস্কৃতে লেখা।“ বলে অধীর পুঁথিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন।

ফুলঠাম্মি বললেন,” ও তোমার দাদুকে জিজ্ঞাসা কর। উনি বলতে পারবেন।“ 

“ ঠাম্মি ঠিকই বলেছেন। তোরা একবার দাদুকে গিয়ে দেখা।“ বললেন নীলিমা।

বাবার কাছ থেকে পুঁথিটা নিয়ে অনুষ্কা তক্ষুনি ছুটল দাদুর ঘরে, বলাই বাহুল্য ভরতও ওর পিছু নিলো। 


দাদু পুঁথিটা দেখে বললেন, “ আরে বাপরে! দিদি তুমি তো দারুণ কাজ করেছ! এতো অনেক পুরনো পুঁথি!” 

“ কি আছে এই পুঁথিতে?” অনুষ্কার চোখ উৎসাহে জ্বলজ্বল করছে।

ওর উৎসাহ দেখে দাদু মজা করে বললেন, “ কি জানি? হয়ত খাজানা! “

“খাজানা!!” অনুষ্কা আর ভরত একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো।

“  হা হা হা ! কে জানে? তবে এই রকম অনেক পুঁথি আমাদের পৈত্রিক ভিটাতে ছিল। “

“এটা কি আপনাদের পৈত্রিক ভিটা নয়?”

“এই বাড়িটাও অনেক পুরনো ,  প্রায় দেড়শ বছর। কিন্তু আমাদের আদি বাস ছিল এখান থেকে কিছু দূরে এক গ্রামে। যেটা এখনকার ঝুসির কাছে। আগে ওখান দিয়ে গঙ্গা বইতো। সেখানে আমাদের অনেক জমি জায়গা ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষরা  শিক্ষক ছিলেন। বাড়ীতে টোল ছিল। অনেক ছাত্র সেখানে পড়তে আসতো ।“ 

“ তাহলে ওই বাড়ী ছেড়ে আপনারা চলে এলেন কেন?”

“ সে এক দারুণ গল্প। আমরা শৈব মানে আমাদের ইষ্ট দেবতা শিব। ওই গ্রামে আমাদের যে আদি বাড়ী আছে সেখানে একটা শিব মন্দিরও আছে। এখন অবশ্য তার খুবই ভগ্ন দশা...। গল্প শুনেছি যে বহু বছর আগে ওই মন্দিরে একজন মহান সাধু, তার ভক্তদের নিয়ে এসেছিলেন। ওনার নাকি অনেক দৈবী শক্তি ছিল। দিকে দিকে ওনার কথা ছড়িয়ে পড়ে। প্রচুর ভক্তের সমাগম হতে থাকে। তারপর একদিন ওই মন্দিরেই উনি মহাসমাধি লাভ করেন। উনি মারা যাবার পর ওনার শিষ্যরা নাগপাশ দিয়ে ওই মন্দিরটা বন্ধ করে দেন । আর সবাইকে ওই মন্দিরে প্রবেশ করতে বারণ করেন। ওনারা এও বলেন যে যদি কেউ মন্দিরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে, তার সমূহ ক্ষতি হবে। উপযুক্ত সময়ে ওনারা এসে মন্দিরকে নাগপাশ মুক্ত করবেন।“

“ তারপর থেকে কেউ আর মন্দিরে ঢোকে নি?”

“ চেষ্টা করেছিল কয়েকজন, কিন্তু তারা সবাই সাপের কামড়ে মারা যায়।“ 

“ তা ওনারা এসেছিলেন মন্দির খুলতে?”

“ নাহ! ওই মন্দিরে আর কোনোদিন পুজো হয়নি। তারপর গঙ্গা নদী তার পথ বদলায় আর আমাদের গ্রাম মরুভুমি হয়ে যায়। সমস্ত লোক ওই গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। আমরা চলে আসি তখনকার প্রয়াগ মানে এখনকার এলাহাবাদে। ওখানকার কিছু জিনিষ ও আমাদের সঙ্গে চলে আসে।“

“ওখানে আর কেউ থাকে না?”

“ বহুদিন ওই বাড়ীতে কেউই থাকতো না। আমরা মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসতাম। কিন্তু কয়েক বছর আগে আমাদের এক জ্ঞাতি পরিবার ওখানে বসবাস শুরু করে । এখন ওরা ওই মন্দির আর বাড়ী দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছে।“      

“আচ্ছা এই সন্ন্যাসী কত দিন আগে এসেছিলেন?”

“ঠিক জানিনা। তবে গল্প শুনেছি প্রায় হাজার বছর আগে।“

নিচের থেকে ফুল ঠাম্মি ডাকলেন ,” দিদি তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে যাবে আমার সঙ্গে?

গল্প শুনতে শুনতে কখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে ওদের খেয়ালই নেই। অনুষ্কা ডাক শুনে উসখুস করে উঠতেই দাদু বললেন,” আজ এই পর্যন্তই থাক। বাকি গল্প আরেকদিন হবে’খন।“

” ঠিক আছে। তাহলে আমি আসি দাদু ?” বলে উঠে পড়লো অনুষ্কা। 

“ এসো দিদি।“ 


এক ছুটে সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে গেলো অনুষ্কা ,” এসে গেছি! চল।“

“দাঁড়াও আমি কাপড়টা ছেড়ে আসি। তোমার আর এই ঠাণ্ডায় কাপড় ছাড়তে হবে না, তুমি শুধু আমার সঙ্গে থাক।“ 

অনুষ্কা গেলো ঠাম্মির সঙ্গে, সদর দরজার পাশে তুলসী মঞ্চ। সেখানে গিয়ে তুলসী মঞ্চ পরিষ্কার করে, জল দিয়ে, প্রদীপ দিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে দিলেন ফুলঠাম্মি।  অনুষ্কার এই সব দেখতে খুব ভালো লাগে। ও ফুলঠাম্মি কে জিজ্ঞাসা করলো,” তুলসীতলায় প্রদীপ কেন দাও?”

“ বাড়ির সকলের মঙ্গলকামনায়। তুলসী ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর ভক্ত। ভগবান বিষ্ণু তুলসীকে আশীর্বাদ করেছিলেন যে তুলসী ছাড়া কখনই তাঁর পুজো হবেনা। আমরা বিশ্বাস করি তুলসী, মা লক্ষ্মীরই রূপ। বলে, যে বাড়ীতে তুলসী থাকে সে বাড়ীতে সদা লক্ষ্মী বিরাজ করে। এতো গেলো পুরাণের কথা। তুলসীর ভেষজ গুণও অনেক, এই যেমন সর্দিকাশিতে যদি তুলসী পাতার রস খাওয়া যায় তাহলে... ” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন উনি কিন্তু এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো। 

ঠাম্মি বললেন “ যাও তো দিদি দরজাটা খুলে দাও।“ 


অনুষ্কা ছুটে গেলো দরজাটার কাছে। দরজা খিল দিয়ে বন্ধ। ভরত ওকে শিখিয়েছে কিভাবে খিল খুলতে হয়। দরজা খোলার আগে ও জিজ্ঞাসা করলো,” কউন? ”

ওদিক থেকে ভরাট গলায় উত্তর এলো, “বাঁশদেও!”

অনুষ্কা একটু থমকে গেলো, তারপর পিছন ফিরে ফুলঠাম্মিকে জিজ্ঞাসা করলো,   “বাঁশদেও বলছে। সে কে?”

“ ও বাসুদেব এসেছে, দুধ দিতে, দরজা খুলে দে। “


অনুষ্কার হি হি হাসি আর থামে না। কোনরকমে দরজা খুলে দিয়ে ও মুখ চিপে ছুটে ঘরে চলে গেলো। ঘরে ঢুকেই সামনে মা কে পেয়ে ও হাসিতে ফেটে পড়ল, “ মা বাসুদেব নিজের নামকে বলে বাঁশদেও......হি হি হি!”

মেয়ের হাসি দেখে মাও হাসতে শুরু করে দিলেন।

প্রবাসী বাঙালি, অনেকদিন ধরে জড়িত লেখালিখির সঙ্গে !

প্রবাসী বাঙালি, অনেকদিন ধরে জড়িত লেখালিখির সঙ্গে ! 

পর্ব ২

 

(৩)

সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সারা আকাশ যেন সিঁদুর খেলছে। অনুষ্কা ভাঙ্গা মন্দিরের পাথরের দালানে পা ঝুলিয়ে বসে একদৃষ্টে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখছিল। মন্দিরটা জঙ্গলের কিনারায়। সামনে  ধু ধু করছে খোলা প্রান্তর। একটা খুব করুণ সুর বাজছে কোথাও। তারপর সুরটা বদলে গিয়ে একটা কান্নার মত হয়ে গেলো। কে যেন কাঁদছে! তারপর মনে হল কে যেন ডাকছে। অনেক দূর থেকে ডাকছে। খুব ধীরে শোনা যাচ্ছে তার গলা। খুব কষ্ট হচ্ছে অনুষ্কার। গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকাচ্ছে।

ঘেমে নেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো অনুষ্কা । জেগে ওঠার পরও ও পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে সেই ডাকটা।  ওকে ওরকম ধড়মড় করে উঠে বসতে দেখে ফুলঠাম্মিও ঘুম থেকে উঠে বসলেন। “কি হয়েছে দিদি?”

ফুলঠাম্মির সাথে শুয়েছে অনুষ্কা । এই কদিন ও উপরের ঘরে ফুলঠাম্মির সাথেই শোবে। ফুলঠাম্মি খুব যত্ন করে ওর জন্য বিছানা করে দিয়েছেন। অনেক রাত অবধি গল্প করে ওরা ঘুমোতে গেছে। পুরনো দিনের কত গল্প বললেন ঠাম্মি ওকে, ওর ঠাকুমার গল্প, দাদুর গল্প, বাবার ছোটবেলার গল্প।  গল্প শুনতে শুনতে কখন যে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল ওর খেয়াল নেই। মাঝরাতে হঠাৎ এই দুঃস্বপ্ন দেখে ওর ঘুমটা ভেঙে গেল। 

“জল খাবে?” জিজ্ঞাসা করলেন ফুলঠাম্মি।

“হ্যাঁ...” অনুষ্কার গলা শুকিয়ে কাঠ।

ফুলঠাম্মির এনে দেওয়া জলের গ্লাসটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দিল ও।

“ তুমি তো একদম ঘেমে গেছো এই ঠাণ্ডায়, কি হয়েছে দিদি?”

“ আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম ঠাম্মি ,  কেউ আমাকে ডাকছে।“

“ ও রকম হয় মাঝে মাঝে...... তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়।“ অনুষ্কাকে শুইয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন ঠাম্মি। অনুষ্কা আবার ঘুমিয়ে পড়লো। 

ভোরবেলায় ভরত এসে হাজির। আজ ও স্কুলে যায়নি। আজ সারাদিন ও অনুষ্কার সঙ্গে খেলবে। 

“ জলদি উঠো! যমুনাজীকে উপর সানরাইস নাহি দেখনা হ্যায়?” উৎসাহে লাফাচ্ছে ভরত।

অনুষ্কাকে জবরদস্তি বিছানা থেকে নামিয়ে নিয়ে গেলো পিছনের বারান্দায়। ওখান থেকে যমুনা নদী দেখা যায়। ওরা ওখান থেকে সূর্যোদয় দেখলো।  সত্যিই অপূর্ব! সূর্যের কিরণ ধীরে ধীরে আকাশ আর যমুনার জলে ছড়িয়ে পড়ে এক অলৌকিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করলো। অনুষ্কার আবার মনে পড়ে গেলো স্বপ্নে দেখা সেই মন্দিরটার কথা। বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ও।  সম্বিত ফিরে পেল একটা ‘খটাখট’ শব্দে। দেখল ভরতের দাঁতে দাঁত লেগে শব্দটা হচ্ছে। এখন এলাহাবাদে খুব ঠাণ্ডা কিন্তু ভরতের পরনে একটা হাফপ্যান্ট আর একটা ছেঁড়া ফুলশার্ট। ওর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। 

ঘরে গিয়ে অনুষ্কা মাকে সে কথাটা বলতেই,  নীলিমা ভরতকে ডেকে, ওকে অনুষ্কার একটা সোয়েটার দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সোয়েটারটা পরে নিল ভরত। তারপর একগাল হেসে বলল,” কিতনা নরম! গুদগুদি হো রহি হ্যায়।“ আর তারপর যেটা করলো সেটা আরও মজার। যেন খুব কাতুকুতু লাগছে এরকম একটা ভান করে শরীরটাকে বেঁকিয়ে দু বার ডিগবাজি খেয়ে নিল ও। ওর কাণ্ড দেখে সবাই হেসে আর বাঁচে না।   

“ তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নে। চল তোদের  ঘণ্টা-ওায়ালার দোকানের জেলেবি রাবড়ি খাইয়ে আনি!” বললেন অধীর। 

মিনিট দশেকের মধ্যে তৈরি হয়ে ওরা তিনজন চলল পাড়ার মোড়ের ঘণ্টা-ওয়ালার দোকানে। ভরতের খুব মজা, সেও চলেছে মিষ্টি খেতে। পাশের বাড়ির ভদ্রলোক ওদের দেখে বললেন,” ক্যা বিটিয়ারানী,  ঘুমনে যা রাহি হো?”

অনুষ্কা হিন্দি ভাষাটা খুব একটা বোঝেনা, তাই হেসে উত্তর দিলো,” নাহি এখুনি ঘুমিয়ে উঠা, এখন বেড়াতে যা রাহা।“

ভরত ভালই বাংলা বোঝে, সে তো ওর জবাব শুনে হেসেই খুন। 

ঘণ্টা-ওায়ালা মিষ্টির দোকানের মালিক অধীরকে খুব ভালোভাবে চেনে। ওদের আসার কারণ জানতে পেরে ওদের জন্য স্পেশাল থালার মাপের বিরাট বিরাট জিলিপি আর তার উপরে রাবড়ি ঢেলে খুব যত্ন করে খেতে দিল। 

বাবা বললেন, “ এতো বড় জিলিপিকে, জিলিপি বলা ঠিক না। এটাকে বরং ‘জেলে-বা’ ডাকা যাক।“ শুনে ওরা খুব মজা পেল। অনুষ্কা পুরো জিলিপিটা খেতেই পারলো না। ভরত নিজেরটা খেয়ে, তারপর অনুষ্কার বাকিটাও খেয়ে নিলো।  

টাকা পয়সা মিটিয়ে অধীরবাবু ভরতকে বললেন,” তু আভি ঘর যা। আর বাড়ীতে বলেদিস যে আমাদের ফিরতে একটু দেরী হবে।“

ভরত একটু ইতস্তত করলো, মনে হল যেন ও বাড়ী যেতে চায় না কিন্তু মুখের ওপর কিছু বলতে পারলো না। পা ঘষতে ঘষতে চলে গেলো।

তারপর ওরা দুজন একজনের বাড়ী নিয়ে গেলো। বাড়ীটা ওই পাড়াতেই, ফুলঠাম্মির বাড়ীর কয়েকটা বাড়ী পরে। বাগান ঘেরা ছোট একতলা বাড়ী। বাগানের গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকে অধীরবাবু সদর দরজার কড়া নাড়লেন। একজন খুব বৃদ্ধলোক, যার মাথার সবকটা চুল পাকা, এসে দরজাটা খুলে দিলেন। তারপর খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে অধীর বাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন চেনার চেষ্টা করছেন। 

“ স্যার! ম্যায় আধীর, পহচানা?” বলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন অধীর।

“ আরে! কায়সে হো? আও অন্দর আও। কিতনে দিন বাদ...!“ ওনার সারা মুখ হাসিতে উজ্জ্বল।

ওরা দুজন ওনার সাথে বাড়ীর ভিতরে গিয়ে বসার ঘরের কাঠের সোফা সেটের ওপর বসলো। অধীর পরিচয় করিয়ে দিলেন, “অনুষ্কা! ইনি হচ্ছেন আমাদের মিশ্রা স্যার। ইনি এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির সংস্কৃত ডিপার্টমেন্ট এর এইচ ও ডি ছিলেন। আর স্যার, এই আমার মেয়ে অনুষ্কা । “ 

অনুষ্কা উঠে গিয়ে ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। 

উনি অনুষ্কাকে আশীর্বাদ করলেন। 

“ তারপর কেমন আছ? কবে এসেছ?”

“ আমরা কালই এসেছি। স্যার আপনার সঙ্গে একটা দরকার ছিল।“

“বোলো বেটা!”

“ আমার মেয়ে একটা পুঁথি খুঁজে পেয়েছে এই বাড়ীর চিলেকোঠা থেকে। এই দেখুন। আপনি যদি এটা দেখে কিছু বলতে পারেন।“ অধীর পুঁথিটা বার করে ওনার হাতে দিলেন।

মিশ্রাজী ভিতর থেকে চশমা আর একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে এলেন। তারপর চশমাটা পরে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ভালো করে পুঁথিটা দেখতে লাগলেন।  মিশ্রাজি কয়েক  মিনিট পর, যখন মুখ তুলে তাকালেন, ওনার মুখের চেহারা একদম বদলে গেছে। 

“এই পুঁথি তুমি কোথায় পেলে? এতো অমৃতসিদ্ধি ! “

“ মানে?” 

“ অমৃতসিদ্ধি হল হঠ যোগের ওপর লেখা সবচেয়ে পুরনো গ্রন্থ। তুমি নিশ্চয় জানো হিন্দু দর্শনে যোগের প্রধান শাখা গুলি হল রাজযোগ, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ আর হঠযোগ। হঠযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে শরীরকে সুস্থ, সবল ও দীর্ঘায়ু করা। হঠযোগীদের ধারণা কোনোরকম শক্তিকে আয়ত্ত করতে হলে শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করা প্রয়োজন। শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম, অর্থাৎ শরীর মন সুস্থ না থাকলে জাগতিক বা পারমার্থিক কোনও কর্মই সুষ্ঠভাবে করা যায় না। অমৃতসিদ্ধি দুটি ভাষায় লেখা হয় সংস্কৃত আর তিব্বতীয়। এই গ্রন্থটি লেখা হয় একাদশ শতাব্দীতে, লেখেন তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ভিক্ষুরা। “ থামলেন মিশ্রাজি, ওনার দৃষ্টি জানালার বাইরে।

“তোমাদের সঙ্গে কি আর কেউ এসেছে?”

“না তো!”

“আসলে জানালা দিয়ে কেউ উঁকি মারছে...একটা ছোট ছেলে বোধহয়।“ বললেন মিশ্রাজি

“ বোধহয় ভরত। আমি দেখছি।“ বলে অনুষ্কা বাইরে দেখতে গেলো। কিন্তু বাইরে ও কাউকে দেখতে পেলো না। ও ফিরে এসে আবার নিজের জায়গায় বসলো।  

“ এই পুঁথিতে কি লেখা আছে?” জিজ্ঞাসা করলেন অধীর।

“এই পুঁথিতে মহামুদ্রা প্রক্রিয়ার বর্ণনা আছে। এই মুদ্রা শরীর ও মনকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রন করে যে মানুষ মৃত্যুকে জয় করতে পারে। “  

“ এও কি সম্ভব?”

“ কেন তুমি যোগী হরিদাসের কথা শোন নি?” 

“ ওই যিনি মহারাজা রণজিৎ সিং এর রাজসভায়...।“

“ হ্যাঁ হ্যাঁ! তাহলে তো তুমি জানো। কিন্তু এই পুঁথিটার শেষ কয়েকটি পাতা অন্যরকম।“

“ কি আছে ওই শেষের পাতাগুলোতে?” 

“ ঠিক বুঝতে পারছি না। একটা মন্দিরের উল্লেখ আছে। এর বেশি আমার পক্ষে এখুনি বলা মুশকিল। কিন্তু তুমি যদি চাও তাহলে আমি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি। তুমি এক কাজ কর এই শেষ কটা পাতা আমাকে জেরক্স করে দিয়ে যাও। “

অধীর বললেন ,” ঠিক আছে আমি আপনাকে জেরক্স দিয়ে যাচ্ছি। আসি স্যার? “

“ আচ্ছা। কিন্তু পুঁথিটা সাবধানে রেখ। ওটা priceless!”

ফেরার পথে ওরা ওই পুঁথির শেষ কয়েকটা পাতা জেরক্স করিয়ে নিল। বাড়ী ফিরেই  অধীরবাবু পুঁথিটাকে ওদের বড় সুটকেসটার মধ্যে ভরে, কম্বিনেশন লক লাগিয়ে দিলেন। 

(৪)

অনুষ্কা দেখলো বাড়িতে মা আর ফুলঠাম্মি খুব ব্যস্ত , রান্নাঘরে। খাস্তা কচুরি, লবঙ্গলতিকা সব বানানো হচ্ছে। অনুষ্কা, জানকী দিদিকে জিজ্ঞাসা করলো,” এতো কি বানাচ্ছো?” 

“ তোমরা সঙ্গমে নাহাতে যাবে, তাই সব খাবার নিয়ে যাবে। ওখানে খাবে। “ জানকীদিদি বলল। জানকী ফুলঠাম্মির কাজের লোক। 

অনুষ্কার খুব অবাক লাগে। ওরা যখন ওদেশে বেড়াতে যায়, তখন খাবার বাইরের কোন রেস্তোরাঁতে  খেয়ে নেয়। এখানে বেরনোর জন্য ঠাম্মি ফ্লাস্কে চা বানিয়ে নিলেন, টিফিনবক্স ভর্তি করে খাবার নিলেন। এখানে কি লোকে রেস্টুরেন্টে খায় না? 

ওরা তিনজন, ভরত আর ফুলঠাম্মি যাবে সঙ্গমে স্নান করতে।  জানকী দিদি যাবে না, দাদুকে দেখাশোনা করার জন্য কাউকে তো বাড়িতে থাকতে হবে? বাবা নিমরাজি , খুব ঠাণ্ডা, স্নান করে ঠাণ্ডা লাগলে নিউমোনিয়া হবে। ঠাম্মি বললেন ,” ছাড়তো তোর নিউমোনিয়া! কিচ্ছু হবে না। বউমা, বদলানোর জন্য জামাকাপড় আর তোয়ালে টোয়ালে সব নিয়ে নাও। “  

মা জামা কাপড়ের ব্যাগ প্যাক করে নিলেন। ঠাম্মি বেতের ঝুড়িতে খাবার ভর্তি টিফিনবক্স , চায়ের ফ্লাস্ক , কমলালেবু, জলের বোতল সব ভরে নিলেন। একটা থলিতে নিজের একটা শাড়ি, জামা আর দুটো গামছা ভরে নিলেন। একটা ওনার, একটা ভরতের। বাড়িতে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। 

তারপর ভরত ছুটলো রিক্সা ডাকতে। দুটো সাইকেল রিক্সা এসে দাঁড়ালো দরজার সামনে। একটা রিক্সাতে বাবা, মা, আর অন্যটাতে ঠাম্মি, অনুষ্কা আর ভরত। অনুষ্কা জীবনে এই প্রথম রিক্সা চড়ছে। ঠাম্মি নিজে প্রথমে উঠে বসে অনুষ্কাকে তুলে নিলেন নিজের পাশে, তারপর ভরত খাবার আর জামাকাপড়ের ব্যাগগুলোকে ওদের পায়ের সামনে রেখে দিয়ে, নিজে রিক্সার পিছনের রডের উপর অনায়াসে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। রিক্সা চললো সঙ্গমের দিকে। অনুষ্কার খুব মজা লাগছে। মাথার উপর খোলা আকাশ, মুখে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগছে, আশপাশের সবকিছু দেখা যাচ্ছে। ওদের এসি গাড়ির জানালা থেকে দেখা চারপাশ থেকে একদম আলাদা। 

সঙ্গমে পৌঁছে অনুষ্কা দেখল দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি।  সঙ্গমের ঘাটে প্রচুর নৌকা দাঁড়িয়ে আছে।  ঠাম্মি একটা নৌকা ভাড়া করলেন। নৌকোর ছইয়ের মধ্যে ওদের ব্যাগগুলো রাখা হল, আর ওরা বসলো বাইরে। বাইরে কাঁচামিঠে রোদে বসতে খুব ভালো লাগছিল। মাঝি ওদের সঙ্গমের মাঝখানে নিয়ে গেলো। একদিকে গঙ্গার ঘোলা জল আর আরেক দিকে যমুনার সবজে নীল জল এসে মিশছে সঙ্গমে। 

অনুষ্কাকে বাবা বললেন,” এটা ত্রিবেণী সঙ্গম মানে এখানে তিনটি নদী মিলেছে। গঙ্গা, যমুনা আর সরস্বতী।“ 

“ সরস্বতী কই?”

“সরস্বতী ফল্গু, অন্তঃসলিলা। মানে মাটির নিচে দিয়ে বয়। তাই তাকে দেখা যায় না।“     

মাঝি নৌকোটাকে জলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল এবার সবাই জলে নেমে স্নান করতে পারো। ওরা অবাক! এখানে কি করে স্নান করবে। মাঝি বলল ও সকলকে জলে হাত ধরে নামিয়ে দেবে । এখানে জল বেশী না। নেমে দাঁড়ানো যায়। জলে ডুব দেবার পর মাঝি আবার হাত ধরে তুলে নেবে। 

প্রথমে ভরত। ভরত জামা ছেড়ে গামছা পরে রেডি। মাঝি ভরতকে নৌকার ধারে দাঁড় করিয়ে দিল।  তারপর ও নৌকোর ধারটা ধরে, ধীরে ধীরে নিচে জলে নেমে গেলো, মাঝি ওর হাতটা ধরে ওকে জলে ডুবিয়ে তুলে নিলো। ও উঠে তাড়াতাড়ি নৌকার ছইয়ের ভিতরে গিয়ে, গা মুছে জামা পরে নিলো। এবার অনুষ্কার পালা। অনুষ্কা সোয়েটার মোজা ছেড়ে, স্লাক্স আর টিশার্ট পরে জলে নেমে  পড়ল।   

মাঝি ওর হাতটা ধরে ওকে যেই জলে ডোবাল, ওর একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। ওর মনে হল জলের গভীর থেকে ওকে কেউ ডাকছে, খুব করুণ সে আর্তি। কেউ যেন খুব কষ্টে আছে। অনুষ্কার বুকের ভিতরে একটা কান্না দলা পাকিয়ে গলার কাছে উঠলো, আর ও সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞা হারাল। মাঝি ওকে টেনে তুলে, কোলে করে নৌকার পাটাতনে শুইয়ে দিল। মা, বাবা অবাক, সুইমিং চ্যাম্পিয়ন অনুষ্কার কাছে জলে ডুব দেওয়া কিছু নতুন না। 

ওর জ্ঞান এলে ওর জামাকাপড় বদলে ওকে গরম চা খেতে দিলেন ঠাম্মি। বাবা মা ওকে উঠে চা খেতে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু ওকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলো না।

সকলের স্নান হয়ে গেলে ফুল ঠাম্মি ওনার ঝুলির থেকে বার করলেন করলেন খাস্তা কচুরি আর লবঙ্গলতিকা। ওই সময়ে নৌকায় বসে এসব খাওয়ার মজাই আলাদা।  অনুষ্কা কচুরি আর লবঙ্গলতিকা মাঝিকে দিতেই, সে একগাল হেসে ওগুলোকে ব্যাগে পুরে রেখে দিল। 

অনুষ্কা জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি খাচ্ছ না কেন?”

মাঝি বলল ,” মেরা বেটা , তুমহারে উমর কা। উসকো ইয়ে সব খানা বহুত পসন্দ হাই। উস্কে লিয়ে লে যা রহা হুন।“

অনুষ্কা ওর ঠাম্মিকে জিজ্ঞাসা করে মাঝিকে আরও কয়েকটা কচুরি আর লবঙ্গলতিকা দিল। লোকটার মুখটা দেখবার মতন হয়েছিল। অনুষ্কার হঠাৎ মনে হল, পৃথিবীতে কত মানুষের কত দুঃখ!  ও কত লাকি, যে ভগবান ওকে এরকম একটা সুন্দর জীবন দিয়েছেন। 

নৌকাটা এলাহাবাদ ফোর্টের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। জল থেকে সোজা উপরে উঠে গেছে ফোর্টের দেওয়ালটা। ওরা সবাই মাথা উঁচু করে ফোর্টের উপর দিকটা দেখছিল। 

“ জানিস তো ১৫৮৩  সালে মুঘল সম্রাট আকবর এই ফোর্টটা বানিয়েছিলেন। তখন এই শহরের নাম ছিল প্রয়াগ। আকবর এই শহরের নাম দেন ইলাহাবাস। পরে নাম বদলে হয় এলাহাবাদ। শোনা যায় আকবর যেখানে এই কেল্লা নির্মাণ করেন সেখানে দিয়েই বইতো সরস্বতী নদী। কেল্লার মধ্যে রয়েছে অক্ষয় বট, শোনা যায় যে এই অক্ষয় বট ছিল সরস্বতী নদীর তীরে। এই বটের নাম অক্ষয় বট কারণ এর কোনও ক্ষয় নেই, আদি অনন্ত কাল ধরে গাছটি ওখানে রয়েছে।“

“ আদি অনন্তকাল মানে?”

“ লোকে বিশ্বাস করে মহা প্লাবনের সময়ও এই অক্ষয় বট ডোবেনি।  রামায়ণেও এই অক্ষয় বটের উল্লেখ পাওয়া যায়। ফোর্টে রয়েছে পাতালপুরী মন্দির যেখানে অক্ষয় বটেরও পুজো হয়।পুরনো দিনে লোকে বিশ্বাস করতো যে অক্ষয় বট থেকে যমুনায় লাফিয়ে পড়ে যে মারা যায় সে মুক্তি পায়। তাই বহু লোক এই গাছে চড়ে আত্মহত্যা করত। আকবর এই প্রথা বন্ধ করেন। গাছটিকে দুর্গের মধ্যে ঘিরে নেওয়া হয় যাতে কেউ ওই গাছে চড়তে না পারে। ঔরঙ্গজেব অনেকবার গাছটিকে নষ্ট করে ফেলার চেষ্টা করেন কিন্তু উনি সফল হননি। “     

অনুষ্কা অবাক হয়ে গল্প শুনছিল।  

সকলকে  কমলালেবু দিতে দিতে ঠাম্মি বললেন, “ তোর মনে আছে অধীর, সেই নামকরা সাঁতারুর কথা? সেই যে এই ফোর্টের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল?”

“মনে নেই আবার? বাবাঃ ! কি হৈচৈ...।“

নীলিমা জিজ্ঞাসা করলেন,” কি হয়েছিল বলোনা?”

অধীর বললেন “ এলাহাবাদের একজন সুইমিং চ্যাম্পিয়ন ছিল, রবিন চ্যাটার্জি, সাঁতারে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন,  একদমে যমুনা পার করতে পারতো। সে একবার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে এই ফোর্টের ওই ওপর থেকে জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। কথা ছিল ঝাঁপ দিয়ে ও সোজা যমুনার ওপারে সাঁতরে উঠবে। কিন্তু ও ঝাঁপ দেওয়ার পর আর উঠলোই না। আসলে এই ফোর্টের একটা অংশ বহুদিন আগে ভেঙ্গে পড়েছিল যমুনাতে। সেই টুকরোগুলো জলের তলায় রয়ে গেছে। ব্রিটিশ আমলে, ওপর থেকে ফোর্টটা সারিয়ে নেওয়া হয়েছে। লোকে বলে ও বোধহয় জলের নিচের ওই পাথরের টুকরো গুলোতে আটকে গিয়েছিল, আর উঠতে পারে নি। ওর বডিও পাওয়া যায় নি। ডুবুরি দিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছিল, কিন্তু কোন ফল হয় নি।“

গল্পটা শুনে সবার মন খারাপ হয়ে গেলো। নৌকোটা চুপচাপ ঘাটে এসে ভিড়লো। তারপর রিক্সা নিয়ে ওরা বাড়ী ফিরে এলো।

ওরা বাড়ী ঢুকতেই জানকী দরজা খুলে দিয়ে সকলকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে লাগলো। 

নীলিমা বললেন,” এই প্রণাম করছ কেন?”

ফুলঠাম্মি হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন ,” আরে বুঝলে না? ও তোমার পুণ্যের ভাগ নিচ্ছে। এখানকার লোকেরা বিশ্বাস করে ,যে , কেউ তীর্থ করে এলে, তাকে প্রণাম করলে তার পুণ্যের ভাগ পাওয়া যায়।“

সবাই হেসে উঠতে জানকী মাথায় ঘোমটা টেনে লাজুক হাসি হেসে রান্না ঘরে পালিয়ে গেলো। ফুলঠাম্মি  ভরতকে বাড়ী চলে যেতে বললেন।  

ওরা নিজেদের ঘরে চলে গেলো, ফুলঠাম্মি দাদুকে দেখতে চলে গেলেন উপরে। 

ঘরে ঢুকে মা অনুষ্কাকে জিজ্ঞাসা করলেন,” তোর কি হয়েছিল বলতো? তুই জলে অজ্ঞান হয়ে গেলি কেন?” 

অনুষ্কা অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিল,” কি জানি? ঠিক বুঝতে পারলাম না।“

নীলিমে অধীরকে বললেন,” I think we should consult a doctor.”

অধীর চিন্তিত ভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্চিলেন হঠাৎ সুটকেসের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,” জানকী... কেউ কি আমাদের ঘরে ঢুকেছিলো?” 

জানকী বলল,” নাহি তো!“

“ঠিক হ্যায়।“ তারপর সুটকেসটা টেনে বার করে দেখলেন, কেউ একটা ধারাল কিছু দিয়ে সুটকেসটা খোলার চেষ্টা করেছে।  নীলিমা দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলেন। 

“ এরকম ভাবে আমাদের সুটকেস খোলার চেষ্টা করবে কে ? আর কেন?” 

“শোনো আমার মনে হয় কেউ ওই পুঁথিটা চুরি করার চেষ্টা করছে।“ বললেন অধীর। 

“কি হবে গো?” বললেন নীলিমা।

“অনু তোর আই প্যাডে পুরো পুঁথিটা স্ক্যান করে রাখ। আমি কাল ওটাকে কোন সেফ জায়গায় রেখে আসবো। আর শোন এই ব্যাপারে কেউ এ বাড়ির কারুর সাথে কোন কথা আলোচনা করবে না। ওকে? “ বললেন অধীর। 

অনুষ্কা আর নীলিমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

অনুষ্কা সঙ্গে সঙ্গে পুঁথিটাকে স্ক্যান করে নিলো। অধীরবাবু পুঁথিটাকে আবার ঢুকিয়ে রেখে দিলেন।

ঘণ্টাখানেক বাদে ওরা সবাই বাইরের ঘরে এসে বসলো। জানকী দিদি সকলের জন্য গরম গরম পাকোড়া আর চা নিয়ে এলো। ফুলঠাম্মি চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলেন, “ কাল তোরা কি করবি ভাবছিস?”

“তোমাদের এখানে ভালো ডাক্তার কে আছে? একবার অনুষ্কাকে দেখাবো ভাবছিলাম।“ অধীর বললেন। 

“কেন তোর বন্ধু সমীরই তো ডাক্তার হয়েছে, নৈনীতে প্র্যাকটিস করে। যা না মেয়েটাকে দেখিয়ে নিয়ে আয় আর ওর সাথে দেখাও করে আয়।“   

“ ঠিক আছে। ”

“তাহলে কাল তোরা কোম্পানির বাগানটাও ঘুরে আসিস, ওখানে এখন খুব গোলাপ ফুটেছে আর ভালো পেয়ারাও পাওয়া যাচ্ছে। “

“ এটা ভালো বলেছ। আহা ওখানকার ওই লাল লাল পেয়ারা গুলো কেটে কেটে নুন ছড়িয়ে দেয় , দারুণ লাগে খেতে।“ বলে উঠলেন অধীর।  

পর্ব ৩

(৫)

“সত্যি করে বলতো দিদি, কি হয়েছিল তোমার?” রাতে বিছানায় শুয়ে অনুষ্কাকে জিজ্ঞাসা করলেন ফুলঠাম্মি।

“ কি জানি? আমার মনে হল কে যেন আমায় ডাকছে। অনেক দূর থেকে।“

“ আর কিছু?” গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলেন ঠাম্মি। উনি জানেন, ওনার এই নাতনীটি সবার থেকে আলাদা। 

“ এই ডাকটা আমার স্বপ্নে শোনা ডাকটার মত। কেউ যেনো খুব কষ্টে আছে। খুব যন্ত্রণা পাচ্ছে..... “ বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলো অনুষ্কা ।

“ শুয়ে পড় দিদি। কাল তোমায় আমি এক জায়গায় নিয়ে যাব ভোর ভোর, কেমন?”

“ আচ্ছা।“ বলে শুয়ে পড়ল অনুষ্কা ।

পরের দিন ভোর ছটার সময় উঠিয়ে দিলেন ফুলঠাম্মি। “ দিদি তাড়াতাড়ি দাঁত মেজে তৈরি হয়ে নাও।“

মিনিট কুড়ির মধ্যে অনুষ্কা তৈরি হয়ে এসে দেখে ঠাম্মিও তৈরি। ভরত এসে  গেছে। ঠাম্মি ওকে একটা রিক্সা ডেকে আনতে বললেন। তারপর ঠাম্মি ওদের ঘরের সামনে  গিয়ে ডাকলেন,” বাবা অধীর, আমি একটু আমার গুরুদেবের কাছে যাচ্ছি। অনুষ্কা দিদিকে নিয়ে যাচ্ছি, কেমন? আমরা তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।” 

বাবা ভিতর থেকে উত্তর দিলেন “ ঠিক আছে।“

আবার ওরা তিনজন মানে ঠাম্মি, অনুষ্কা আর ভরত চলল রিক্সা করে। গঙ্গার ধারে গুরুদেবের আশ্রম। ঠাম্মি রিক্সাওয়ালাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। ওরা আশ্রমের গেট খুলে ভিতরে ঢুকলো। আশ্রমটা খুব সুন্দর। ছোট একটা একতলা বাড়ী, সামনে বাগান, বাগানের পর একটা খোলা চাতাল। সেই চাতালের উপর গুরুদেব প্রাণায়াম আর যোগাসন শেখান ভক্তদের। দশ বারোজন শতরঞ্চি পেতে বসে যোগাসন করছে। আর গুরুদেব বসে আছেন উপরের খোলা বারান্দায়। অনুষ্কা দেখল ছিপছিপে রোগা  একজন বৃদ্ধ, মাথার চুল কাঁধ অবধি এসেছে। পরনে সাদা কুর্তা আর ধুতি। মুখে প্রশান্তির ছায়া। ফুলঠাম্মি অনুষ্কাকে নিয়ে ঢুকতেই উনি ওদের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন তারপর হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।

“ আমার নাতনী, অনুষ্কা । আমেরিকা থেকে এসেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করাতে আনলাম। নমস্কার কর দিদি।“

অনুষ্কা পায়ে হাত দিয়ে ওনাকে প্রণাম করলো। উনি ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, তারপর বললেন, “ তুম লোগ থোড়ি দের বাইঠো।“

একটু পরেই ওনার ক্লাস শেষ হয়ে গেলো। সবাই চলে যাবার পর উনি ওদের সামনে এসে বসলেন। 

ফুলঠাম্মি বললেন,” বাবা আমার এই নাতনীটা একটা স্বপ্ন দেখছে ...”

“ কোই বুলা রাহা হ্যায়?”

“ আপনি কি করে জানলেন বাবা?”

গুরুদেব মৃদু হাসলেন, তারপর অনুষ্কাকে বললেন,” মা মেরে আঁখও কে তরফ দেখ। ক্যা দিখ রহা হ্যায়?”

অনুষ্কা ওনার চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে বলতে লাগলো,” একটা ভাঙ্গা মন্দির। খোলা মাঠের মধ্যে, ওই মন্দিরটা ...... ওই মন্দিরটা......”

“ঠিক হ্যায়...ঠিক হ্যায়।“ বলে গুরুদেব ওকে থামিয়ে দিলেন। তারপর চোখ বুজে খানিকক্ষণ ধ্যানস্থ থাকলেন। মিনিট দশেক পর ধীরে ধীরে চোখ মেললেন উনি। 

“তেরি পোতি , সাধারণ লড়কি নহি। উস্মে আধ্যাত্মিক  শক্তিয়া হ্যায়। ইয়ে দুসরে লোককে আওয়াজ শুন সক্তি হ্যায়। ইয়ে কোই  বড়া কাম করনে কে লিয়ে আয়ি হ্যায়। ইয়া তো উয়ো খুদ কুছ বড়া কাম করেগি, নাহি তো কিসিকা কামকা জারিয়া বনেগি। পিছলে জনম মে উয়ও এক  সাধু থি, বহুত সাধনা কিয়া। ইস জনম মে উয়ো বহত লোগোকা উদ্ধার করেগি। শিব শম্ভু উসে রাস্তা দিখায়েঙ্গে।“

ঠাম্মি  কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “ ওই ডাকটা , যেটা ও বার বার শুনছে?”

“ ওই ডাকেই তো উয়ো ইয়াহা আয়ি হ্যায়। তুই চিন্তা মত কর, শিব শম্ভু ওর সাথ আছেন, ওর কোই ক্ষতি নহি কর পায়েঙ্গে।“

ওরা প্রণাম করে বেরিয়ে আসছিল, এমন সময় গুরুদেব ওদের ডেকে, ওদের হাতে একটা করে কালাকন্দ দিলেন। ভরত বাইরে খেলছিল, প্রসাদ দেখে ছুটে এসে প্রণাম করে প্রসাদ নিলো। গুরুদেব ওকে দেখে মুচকি হাসলেন। ওরা বাইরে আসতেই রিক্সাওয়ালাটা ছুটে এলো। অনুষ্কা ওর কালাকন্দ থেকে অর্ধেকটা রিকশাওয়ালাকে দিলো । ফেরার পথে ঠাম্মি অনুষ্কাকে ওনার গুরুদেবের গল্প বললেন ,” জানতো দিদি, ইনি খুব সিদ্ধপুরুষ, সারাদিনে একটামাত্র কালাকন্দ খেয়ে থাকেন।“

অনুষ্কা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,” সারা দিনে কেবল একটা কালাকন্দ? ওনার খিদে পায় না?”

ঠাম্মি হাসলেন,” উনি কি আর সাধারণ মানুষ? এনারা সব হঠ যোগী। যোগবলে উনি নিজের ক্ষুধা তৃষ্ণা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। “

“ উনি এতো কালাকন্দ পান কোথা থেকে?”

“ ওনার ভক্তরা দেয়। উনি কারুর কাছে কোন পয়সা নেন না।“

গল্প করতে করতে ওরা বাড়ী পৌঁছে গেলো। বাবা মা ওদের জন্য অপেক্ষা করে ছিলেন। অনুষ্কা হাত মুখ ধুয়ে সোজা খাবার ঘরে পৌঁছে গেলো। আজ জলখাবার কড়াইশুঁটির কচুরি, আলুর দম আর সঙ্গে একটা কালো মত জিনিষ। অনুষ্কা জিজ্ঞাসা করলো,” এটা কি?”

বাবা বললেন,” এটা কালো গাজরের হালুয়া। এখানে এক রকম বেগুনি রঙের গাজর পাওয়া যায় যাকে কালি গাজর বলে। এই গাজর খুব ভালো শরীরের পক্ষে।“

অনুষ্কা কখনও কালো গাজর দেখেনি, শোনেও নি। ও একটা নতুন জিনিষ দেখল। তাই খাওয়া হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আই প্যাড খুলে পড়তে শুরু করে দিল ও, কালো গাজর সম্বন্ধে, “Baba, do you know  Kali gajar contains 40% more beta carotene than the normal orange variety?”   বলল অনুষ্কা । 

“তাই নাকি? বাঃ একটা নতুন জিনিষ শিখলাম।“ বললেন অধীর।

নীলিমা তাড়া দিয়ে বলে উঠলেন, “ এখন তোমরা ওঠ। আর দেরি করলে মুশকিল।“

ভরত জিজ্ঞাসা করলো, “ আপ লোগ কাহাঁ যা রাহে হো ?” 

অনুষ্কা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, অধীর ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,” ঘুমনে।“ 

আজ অধীর একটা ট্যাক্সি বুক করেছেন। ওরা তৈরি হয়ে বেরোবার সময় অধীর বললেন,”আজ আমরা দুপুরে খাবো না মাসীমা।“

“ও আচ্ছা তোর সেই প্রিয় দোকান নভেলটিতে খাবি? তা বেশ। সাবধানে যাস। দুগগা... দুগগা! ” 

অনুষ্কারা প্রথমে গেলো নৈনীতে ডঃ সমীরকে দেখাতে। রাস্তার ওপরেই ডঃ সমীরের ক্লিনিক।

“আসতে পারি?”কেবিনের পর্দা সরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন অধীর বাবু।

“ ইয়েস... আইয়ে! আরে আধীর যে! কতদিন পর! কবে এলি?” উচ্ছ্বসিত ডঃ সমীর। 

ছোটবেলার বন্ধুকে এতদিন বাদে পেয়ে কি করবেন ঠিক করতে পারছিলেন না ডঃ সমীর। ওনার ওই ছেলেমানুষের মত ছটফটানি দেখে অনুষ্কা খুব মজা পাচ্ছিল। ওদের নিজের কেবিনে বসিয়ে একজনকে পাঠালেন ওদের জন্য সরবত মিষ্টি সব আনার জন্য। কোনও আপত্তিই শুনলেন না। 

“ না না ভাবী আধীর আমার লাঙ্গোটিয়া ইয়ার আছে। উস্কে লিয়ে জান হাজির। উও আমি কুছু সুনবে না। এ তো কুছ ভি নাহি একদিন ঘরপে আও। অচ্ছে সে খাতিরদারি করেঙ্গে।“ ডঃ সমীর অনর্গল ওনার হাত পা ভাঙা বাংলায় কথা বলে চলেছেন। 

“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে । সে না হয় একদিন আসা যাবে। তুই এখন একটু শান্ত হয়ে বস তো!” হাসতে হাসতে বললেন অধীরবাবু। 

“ আরে শান্ত ? শান্ত কি করে হোবে? পাতা হ্যাঁয় ভাবী ইয়ে আধীর নাহি হোতা তো হাম আভি জিন্দা হি নাহি হোতে।“

“ সেকি?” আঁতকে উঠলেন নীলিমা।

“ আরে না না সেরম কিছু না । ও একটু বাড়িয়ে বলছে। একবার ও আর আমি ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলাম। ওর পা পিছলে যায়। আমি ওকে ধরে নিই।“

“ তুই তো এমনি বলছিস যে কোই ছোটা মোটা বাত। আরে ভাবী আমার যখন ‘ওই হল’, তখন যদি ওর ‘ওই না হত’ তাহলে আমার কি হত? ভগবানের বহত ‘ওই’ যে আমি আধীরের মত ‘ওই’ পেয়েছি।“

অনুষ্কা আর নীলিমা অত গুলো ‘ওই’ শুনে হতভম্ব। 

ওদের অবস্থা দেখে অধীর মুচকি হেসে বললেন,” ঘাবড়িয়ো না সমীর উত্তেজিত হয়ে গেলে ওর বাংলা প্রতিশব্দ গুলো সবসময় মনে পড়ে না। আসলে ও ভাবছে হিন্দিতে তারপর সেটাকে বাংলাতে অনুবাদ করে বলছে তো তাই এই সমস্যা। ও বলতে চাইছে- ওর যখন পা পিছলালো তখন যদি আমার খেয়াল না হত তাহলে কি হত? ভগবানের অনেক দয়া যে ও আমার মত একজন বন্ধু পেয়েছে। এই ওইটা হল হিন্দির উও, বুঝলে?“

এরপর বহুক্ষণ দুই বন্ধুর গল্প চলল। কথায় কথায় অধীর বাবু অনুষ্কার কথা বললেন। 

“ আরে আভি দেখ লেতে হ্যায়।“

উনি অনুষ্কাকে ভালো করে পরীক্ষা করে বললেন কোন অসুবিধা নেই। শারীরিক ভাবে অনুষ্কা সম্পূর্ণ সুস্থ।

বেরোনোর আগে অধীরবাবু, ডঃ সমীরকে বললেন,” আমার একটা জিনিষ যদি তোর কাছে  কয়েক দিনের জন্য রাখি তো তোর কোন আপত্তি আছে কি? আসলে মাসিমার বাড়ীটা সেফ না, already একটা চুরির  attempt হয়েছে। “ 

“ তুই এতো কিন্তু করছিস কেন? নিশ্চয়ই রাখব!” 

অধীরবাবু ব্যাগ থেকে খবরের কাগজে মোড়া পুঁথিটা ডঃ সমীরের হাতে দিলেন। উনি সযত্নে সেটাকে ওনার লোহার সেফে তুলে রেখে দিলেন। তারপর বললেন,” এটার কোথা কেউ জানবে না। তুই নিশ্চিন্ত থাক। এতে আমি ছাড়া কেউ হাত দেয় না। যব জরুরত হো লে জানা।“

সেদিন কোম্পানির বাগান দেখে, নভেলটিতে লাঞ্চ খেয়ে বাড়ী ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল। 

ওরা বাড়ী ঢুকতেই ফুলঠাম্মি বললেন,” মিশ্রাজির ফোন এসেছিল। তোকে একবার ফোন করতে বলেছেন।“

অধীরবাবু তাড়াতাড়ি মিশ্রা স্যারকে ফোন করলেন,” স্যার, অধীর বলছি।“

“ হ্যাঁ অধীর,  ওই পুঁথির পাতা গুলোতে আমি একটা মন্দিরের উল্লেখ পাচ্ছি। মাটির নিচের মন্দির। যতদূর আমি বুঝতে পারলাম। “

“ ঠিক আছে স্যার। আপনি দেখুন যদি আরও কিছু পান তো আমাকে জানাবেন।“

“ নিশ্চয়ই।“

অনুষ্কা সব শুনে জিজ্ঞাসা করলো, “ আচ্ছা বাবা মাটির নিচের মন্দির মানে কি পাতালপুরী মন্দির?”

“ ঠিক বলেছিস হতেও পারে। আর কোনও মাটির নিচের মন্দিরের কথা তো শুনিনি।“

“কাল যাবে?”

“ ঠিক আছে চল।“

(৬)

সকাল সকাল ওরা দুজন পৌঁছল এলাহাবাদ ফোর্টের পাতালপুরী মন্দিরে। একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে ঢুকে যেতে হয় মন্দিরে পৌঁছোনর জন্য। ওরা মন্দিরের ভিতরে পৌঁছে দেখল বাকি সব দেবতার মূর্তির সাথে অক্ষয় বটেরও পুজো হচ্ছে ওখানে। ওরা দুজন মিলে তন্ন তন্ন করে খুঁজল সারা মন্দিরে যদি যোগ বা যোগ সংক্রান্ত কিছু পাওয়া যায়। ছবি, শিলালিপি বা মূর্তি। কিন্তু সেরকম কিছুই ওরা দেখতে পেলো না। 

ওখানকার পণ্ডিতজীকে অধীরবাবু হঠ যোগীদের কথা জিজ্ঞাসা করাতে উনি বললেন,” যোগীয়োঁ সে মিলনা হ্যাঁয় তো কুম্ভমেলা ময়দান যাও।“

ওনার কথা শুনে ওরা গেলো কুম্ভমেলার ময়দান দেখতে।  বিশাল ময়দানে সারি সারি তাঁবু ফেলা হয়েছে। ১৪ জানুয়ারী প্রথম শাহী স্নান। এবার পূর্ণ কুম্ভ। 

বাবা বললেন ,” প্রত্যেক ১২ বছরে একবার পূর্ণ কুম্ভ হয়। সারা দেশ এমনকি বিদেশ থেকেও লোকেরা আসে। শুধু সাধারণ তীর্থ যাত্রী নয় আসেন মন্ত্রী সান্ত্রী, সাধুসন্ত আর নাগা সাধুরাও। “

অনুষ্কা জিজ্ঞাসা করলো, “ নাগা সাধু কারা?”

“এঁরা শিব ভক্ত  সন্ন্যাসী, আখড়ায় বা হিমালয়ে থাকেন। কুম্ভ মেলার সময় এঁরা আসেন। কুম্ভমেলায় প্রথমে স্নান এনারাই করেন। স্নানের পর এনারা আবার ফেরত চলে যান। এনারা সবাই যোদ্ধা আর ভীষণ বদরাগী। এদের গুরুরা হাতিতে চড়ে আসেন। কুম্ভমেলাকে বলা যেতে পারে পৃথিবীর সব চেয়ে বড় উৎসব। আর কোন উৎসবে এত বেশী লোকের সমাগম হয় না। এবছর সরকার ১ থেকে ১.৫ কোটি তীর্থ যাত্রী আশা করছেন এলাহাবাদে।“

“সে কি গো এতো লোককে পুলিশ সামলায় কি করে? ”

“ হুম ... খুবই মুশকিল কাজ। কয়েক মাসের মধ্যে এখানে একটা ছোট খাটো শহর তৈরি করে ফেলা হয় প্রায়, তীর্থ যাত্রীদের থাকতে দেবার জন্য। স্পেশাল ট্রেন চালান হয়। পুলিশ, ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স সব কিছুর বন্দোবস্ত করা হয়। তবুও সামলানো কঠিন হয়।“

“ কঠিন হয় মানে?”

“ এই কুম্ভমেলাতেই কয়েকবার stampede হয়ে অনেক লোক মারা যায়। ১৯৫৪র টা is considered the worst stampede of Indian history. আসলে ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর সেটা ছিল প্রথম কুম্ভমেলা। অত লোকসমাগম হবে দেখে তখনকার রাজনৈতিক নেতারাও ভাবলেন আমরাও যাই একটু জন সম্পর্ক মানে পাবলিক রিলেশন করে আসি। ভিভিআইপিদের তো আর এমনি আনা যায় না। তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হয়। তারপর সেবার আবার গঙ্গা তার গতিপথ বদলে কুম্ভমেলা ময়দানের আকার ছোট করে দিয়েছিল। অত লোক তার ওপর ভিভিআইপিদের জন্য আলাদা জায়গা করতে গিয়ে জায়গা কম পড়ে যায়। সাধারণত নাগা সন্ন্যাসীদের জন্য আলাদা স্নানের জায়গা থাকে। কিন্তু সেবার ওনাদের সাধারণ মানুষদের ঘাটেই স্নান করতে বলা হয়। আর তোকে তো আগেই বললাম নাগা সাধুদের গুরুরা হাতিতে করে আসেন। মন্ত্রিরা যেই আসতে শুরু করেন পুলিশ সাধারণ মানুষদের সরে যেতে বলে। তাতে শুরু হয় হুড়োহুড়ি । ব্যাস অত মানুষ তার ওপর হাতি। হাতিগুলো ভয় পেয়ে গিয়ে ছুটতে শুরু করে, ফলে মানুষেরাও ভয়ে ছুটতে শুরু করে। হাজার হাজার লোক সেবার পায়ের তলায় চাপা পড়ে মারা যায়। প্রচুর লোক আহত হয়। আসলে যে কত লোক মারা গিয়েছিল সেবার, তার কোন হিসাব নেই। “ 

অনুষ্কার মনটা খারাপ হয়ে যায়। কত লোক আর বাড়ী ফিরতে পারলো না। গল্প করতে করতে ওরা কুম্ভমেলা ময়দানের পৌঁছে গেল। চারপাশের মানুষজন, দোকানপাট দেখতে দেখতে ওরা সঙ্গমের সামনে চলে এলো। অধীর বাবুর একটা ফোন আসাতে উনি একটু দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। অনুষ্কা বেখেয়ালে নানা কথা ভাবতে ভাবতে , এগিয়ে গেলো। এখানে দোকান পাট নেই, চারপাশে খোলা মাঠ, তারপরেই জল। অনুষ্কা একা ওখানে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ দেখল মাঠের মধ্যে সেই ভাঙ্গা পাথরের মন্দিরটা, তার দরজায় একজন সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে , ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সারা আকাশ লাল। ও পরিষ্কার শুনল কেউ আবৃত্তি করছে  -  

ওঁ মহাদেবায় বিদ্মহে

রুদ্র মূর্তয়ে ধীমহি।

তন্নঃ  শিবঃ প্রচদয়াত্।।

সারা আকাশ বাতাসে ধ্বানিত হচ্ছে ওই মন্ত্র...... অনুষ্কা মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। বাবা দেখতে পেয়ে ছুটে এসে ওর মাথাটা কোলে তুলে নিলেন। ওর চোখে মুখে জল দিতেই ও উঠে বসলো।  

বাবা বললেন ,” কি হয়েছে মা তোর?”

“ কিছু না বাবা । একটা কিছুতে পা আটকে পড়ে গেলাম। আর তারপর...” অনুষ্কাকে কেউ একটা যেন ভিতর থেকে বলল আসল ঘটনাটা কাউকে না বলতে।

“ দেখে চলবি তো? কিন্তু পড়ে গেলেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এটা ভালো লক্ষণ না...।” চিন্তিত ভাবে বিড়বিড় করলেন অধীরবাবু।  

সেদিন বাড়ী ফিরতে ওদের সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বাড়ী ফিরে চা খেতে খেতে  ফুলঠাম্মি বললেন ,” তোরা কি আমাদের পৈত্রিক ভিটে দেখতে যেতে চাস? তোর মেসো বলছিলেন। অনুদিদির তো খুব আগ্রহ। যদিও ওখানে বিশেষ দেখার কিছু নেই......”

অধীর জিজ্ঞাসা করলেন,” ওখানে কেউ থাকে কি মাসীমা?”

“আমাদের এক জ্ঞাতি থাকে। জ্ঞাতি মারা গেছে তার বউ আর ছেলে আছে। ছেলেটা হাঁটতে চলতে পারে না। কেউ দেখবার নেই। আমি ভাবছিলাম যদি তোরা যাস, তাহলে আমিও একবার গিয়ে দেখে আসি ।“ 

অনুষ্কা লাফিয়ে উঠলো,” চলো না  বাবা।“

“ঠিক আছে মাসিমা, তাহলে যাওয়া যাক। কি বল নীলিমা?“ জিজ্ঞাসা করলেন অধীর।

“ ভালোই তো।“ বললেন নীলিমা।

“ আমরা তাহলে কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি? কি বল? আর পরশু দিন বিকাল বিকাল না হয় চলে আসবো?”

ঘরে এসে অধীরবাবু মিশ্রা স্যারকে ফোন করলেন। 

“স্যার আমরা পাতালপুরী মন্দিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে কিছু সেরকম দেখলাম না। তারপর কুম্ভমেলা ময়দানেও গেলাম। কিন্তু ...“

“ না না অধীর এটা পাতালপুরী মন্দির না। তুমি একবার আমার সঙ্গে দেখা কর আমি তোমায় সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।“

“ স্যার এখনি আসতে পারি কি? আসলে কাল সকালে আমরা আমাদের দেশের বাড়ী চলে যাব।“

“ ঠিক আছে চলে এস।“ 

ফোন রেখে অধীর বাবু   অনুষ্কাকে ডাকলেন,” অনুষ্কা চল আমরা একবার মিশ্রা স্যারের বাড়ী ঘুরে আসি।“

“ আচ্ছা।“

“ তুম লোগ বার বার উও দাদ্দুকে ঘর কিউ জা রহে হো?” ভরতের প্রশ্ন শুনে অনুষ্কা একটু থমকে গেলো।

“ কেন যাওয়া বারণ নাকি?”

“ নহি ...” ভরত চুপ করে গেল।

পর্ব ৪

(৭)

ভোরবেলার বাসে ওদের রওনা হওয়ার কথা । উত্তরপ্রদেশ গভর্নমেন্ট এর বাস।  বাসে দু ঘণ্টা যাবার পর ওদের ভ্যানরিক্সাতে যেতে হবে প্রায় কুড়ি মিনিট। তবে ওরা পৌছবে ফুলঠাম্মির পুরনো বাড়ীতে।

ওরা বেরোতে যাবে এমন সময় ভরত সঙ্গে একজন উনিশ কুড়ি বছরের ছেলেকে নিয়ে এসে হাজির। ছেলেটির উচ্চতা মাঝারি, মাথায় কোঁকড়া চুল, দেখে মনে হয় মজুরের কাজ করে। 

“ দাদী ইয়ে মেরে ভাইয়া হ্যায়। আমি ওকে নিয়ে এলাম । ও আমাদের সঙ্গে যাবে। মাল উঠাবে, কাম ওয়াম করে দিবে।“ বলল ভরত।

ফুলঠাম্মি খুব খুশি,” বাঃ বেশ করেছিস। বাবা অধীর একে নিয়ে যাই আমরা? ওখানে আমাদের দেখাশোনা করবে’খন। তা তোমার নাম কি?”

“শঙ্কর।” বলল ছেলেটা। 

অধীরবাবু খুব একটা রাজি না হলেও ফুলমাসীমার উপর কিছু বলতে পারলেন না। 

ওরা রওনা হল। এরকম বাসে অনুষ্কা আগে কখনও চড়ে নি। বাসের সবকটা স্ক্রু মনে হচ্ছে ঢিলে। সিটে বসে নড়াচড়া করলে ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ হচ্ছে। অনুষ্কা  খুব সাবধানে একদম নড়াচড়া না করে বসে রইল। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকার কি জো আছে? যেমন ঢিলেঢালা বাস তেমনি এবড়ো  খেবড়ো রাস্তা। ওরা সবাই কুলোর ওপর চালভাজার মতন নাচতে নাচতে চলল। 

বাসে ওঠার পর থেকেই অনুষ্কার মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ও দারুণ একটা উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলো। ও লক্ষ্য করলো ভরত আর ওর ভাই সারা রাস্তা কিসব গুজগুজ করছে আর বার বার ওর দিকে তাকাচ্ছে। অনুষ্কার ওদের তাকানোটা একদম ভালো লাগলো না।  

বাস থেকে নেমে ভ্যান রিক্সা। এই ভ্যান রিক্সায় বসার সিটও নেই। অধীর বাবু বললেন এই ভ্যান রিক্সায় করে সব্জিপাতিও বাজারে পৌছনো হয়। মেয়েরা ভ্যান রিক্সার ভিতর দিকে পা মুড়ে আর ছেলেরা পিছন দিকে পা ঝুলিয়ে বসলো। বাস স্টপ থেকে গ্রাম অবধি রাস্তা মাটির। ভাগ্যিস শীতকাল! নাহলে এই রাস্তায় নাকি একহাঁটু কাদা হয়। 

আধঘণ্টা পর রিক্সা এসে দাঁড়াল একটা বিরাট ভাঙা চোরা বাড়ীর সামনে। বাড়ীটা এতোই ভাঙা যে দেখে মনে হয় না এখানে কেউ থাকে। এখন প্রায় বেলা এগারটা। সামনের ভাঙা গেট খুলে ভেতরে ঢুকে ফুলঠাম্মি ডেকে উঠলেন,” কোই গো বাড়ীতে কেউ আছো?” 

ওনার গলা শুনে একজন বয়স্কা মহিলা বেরিয়ে এলেন। তারপর ফুলঠাম্মিকে দেখে একগাল হেসে বললেন, “ও মা! তুমি এসেছ, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে তোমায় কি বলবো।“ 

উনি এসে ফুলঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরলেন।

“ আমি একা আসিনি গো, সঙ্গে ছেলে, বউ, নাতনি সবাইকে নিয়ে এসেছি। এরা সব আমেরিকায় থাকে । তোমাকে গল্প করেছিলুম মনে আছে তোমার?“

“ হ্যাঁ ! সে আর মনে থাকবে না? বেশ করেছ, ওদের নিয়ে এসে খুব ভালো করেছ। এস ভাই , ভিতরে এস।“ বলে ওদের দিকে তাকালেন উনি।

ফুলঠাম্মি বলে দিয়েছিলেন ওনাকে নতুনঠাম্মি বলতে। অনুষ্কা ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই উনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন,” ওমা! কি ভালো মেয়ে ! বিদেশে থেকেও সংস্কার ভোলেনি।“  

ফুলঠাম্মি একটু গর্বের হাসি হাসলেন।    

ওনাদের বাড়িটা খানিকটা পাকা আর খানিকটা মাটির তৈরি। যে জায়গাটা পাকা সেটা খুব ছোট ছোট ইট দিয়ে তৈরি। সেখানে বেশিরভাগ জায়গাতেই প্লাস্টার খসে গেছে। বাকি জায়গাটা মাটির তৈরি। মাটির ঘরে টালির ছাদ। নতুনঠাম্মি ওদের নিয়ে গিয়ে ওনার ঘরে বসালেন। শঙ্কর আর ভরত ওদের ব্যাগগুলো নিয়ে ভিতরে ওদের থাকার ঘরে চলে গেলো। 

নতুনঠাম্মি ওদের ওনার ছেলে সন্তোষের  সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। ওই ঘরেই উনি আর ওনার ছেলে সন্তোষ থাকেন। সন্তোষ বিছানার থেকে উঠতে পারেন না তাই উনি ওই ঘরেই একটা তক্তপোষে শুয়ে ছিলেন। উনি ছোটবেলায় স্বাভাবিক ছিলেন, মানে হাঁটাচলা করতে পারতেন। খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। কিন্তু ষোল বছর বয়সে ওনার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়, তারপর থেকে ওনার চলাফেরার শক্তি চলে যায়। কিন্তু ওনার বই পড়ার খুব সখ । তাই এখনও উনি যা হাতের কাছে পান তাই পড়েন। নতুনঠাম্মি যেখান থেকে পারেন বই , খবরের কাগজ ইত্যাদি নিয়ে এসে দেন। 

অনুষ্কার সঙ্গে সন্তোষ কাকুর খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। দুজনেরই বই পড়ার শখ। অনুষ্কা ওনাকে ওর আই প্যাডটা দেখাল। ওখানে ইন্টারনেট ছিল না বলে অনুষ্কা ওনাকে ওর সেভ করা পেজ গুলো দেখাল। উনি অবাক হয়ে গেলেন বার বার বলতে লাগলেন , “ এটা তো পৃথিবীর জানালা... পৃথিবীর জানালা! দেখ মা ! ও যা জানতে চায়, যখন জানতে চায় ও সব জানতে পারে এই ছোট্ট জিনিষটা থেকে। মানুষের কি আবিষ্কার, পৃথিবী তোমার মুঠোর মধ্যে।“ 

নতুনঠাম্মি ছলছল চোখে ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন, মুখে কিছু বললেন না। 

অনুষ্কা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, সত্যি তো! ও তো কখনও এভাবে ভেবে দেখেনি। 

একটু বাদে নতুনঠাম্মি জলখাবার খেতে ডাকলেন রান্নাঘরে। ঘর থেকে বেরিয়ে দালান পেরিয়ে বেশ বড় রান্নাঘর। রান্নাঘরেরও মাটির দেয়াল টালির চাল। রান্নাঘরের কোনে একটা মাটির উনুন। অনুষ্কা এই প্রথম এরকম উনুন দেখল। খাওয়ার ব্যবস্থা মাটিতে বসে। উনুনের পাশে সারি সারি চাটাই পেতে দেওয়া হয়েছে। তার সামনে রাখা ছোটো ছোটো চৌকি। সেই চৌকির ওপর থালায় খাবার দেওয়া হয়েছে। আটার পরোটা, বেগুন আলুর সব্জি আর বাড়ীতে বানানো বেসনের লাড্ডু। নতুন ঠাম্মি পরোটা ভেজে ভেজে দিচ্ছেন গরম গরম সবাইকে। খিদের মুখে এই খাবার অমৃত মনে হচ্ছিল। 

ওদের খাওয়া হয়ে গেলে অধীর বাবু বললেন উনি ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করতে চান। অনুষ্কাও ওনার সাথে রান্নাঘর থেকে বেরল। যদিও ওর বিশ্রাম নেবার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। 

রান্নাঘরের বাইরে ভরত আর শঙ্কর খেতে বসেছে। এখানে আসার পর থেকে শঙ্কর আর ভরত অনেক কাজ করেছে। ওদের থাকার ঘর পরিষ্কার করা থেকে রান্নার জন্য জল এনে দেওয়া পর্যন্ত। নতুন ঠাম্মি খুব খুশি, বললেন ,” ভাগ্যিস এই  দুটোকে এনেছিলে দিদি!” 

অধীর ঘরে গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন আর অনুষ্কা নিজের আই প্যাডটা নিয়ে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। বাড়ীর সামনের দিকটায় ওরা আছে। বাড়ীর পিছন দিকটা বিশাল। কিন্তু তার সবটাই ভাঙা। ও ধীরে ধীরে ওই ধ্বংসস্তূপের দিকে এগোতে লাগলো। জায়গাটা ওকে কেমন যেন টানছে। 

“ও দিকটায় যেও না দিদি। যদিও এই শীতে সাপের ভয় নেই কিন্তু ওই সব ঝোপ জঙ্গলে নানারকম পোকামাকড় থাকতে পারে।“ ফুলঠাম্মির গলা।

“ এই একটু সামনেটায় ঘুরছি।“

“ এখন একটু বিশ্রাম করে নাও বিকালে আমি তোমায় বেড়াতে নিয়ে যাব।“ বললেন নতুনঠাম্মি।

অগত্যা অনুষ্কাকে নিজের ঘরে ফিরতে হল।

বিকেল তিনটে নাগাদ দরজায় টোকা দিলেন ফুলঠাম্মি, “ দিদি আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাবে?”

অনুষ্কা বিছানায় উঠে বসে দেখল মা বাবা দুজনেই অকাতরে ঘুমোচ্ছে। ও নিজের আই প্যাডটা নিয়ে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। 

“ মা বাবা তো ঘুমোচ্ছে। কি করবো?”

“ আমরা সন্তোষকে বলে যাচ্ছি। ওরা ঘুম থেকে উঠে খোঁজ করলে সন্তোষ ওদের বলে দেবে।“ বললেন নতুনঠাম্মি। 

বাড়ীর খিড়কীর দরজা দিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো, অনুষ্কা, ফুলঠাম্মি আর নতুনঠাম্মি। বাড়ীর পিছন দিকটা একদম নির্জন আর জঙ্গলে ঢাকা।

“ এই সব জমি একসময় আমাদের ছিল। তাই না?” বললেন নতুনঠাম্মি।

“হ্যাঁ...।“ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফুলঠাম্মি।     

পায়ে চলা পথ এঁকে বেঁকে চলেছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এটা এই গ্রামের শেষ। এখানে কেউ আসেনা। প্রায় মিনিট দশেক চলার পর ওরা একটা খোলা ময়দানে এসে পৌঁছল। 

আর সেই ময়দানের পাশের দিকে জঙ্গলের গা ঘেঁষে একটা ভাঙা মন্দির। সামনে  ধূধূ ময়দান আর পিছনে ঘন জঙ্গল, মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই পাথরের মন্দির, যেন আদি অনন্ত কাল থেকে। মন্দিরটার দিকে তাকিয়ে অনুষ্কা  স্থির হয়ে গেলো। এতো সেই স্বপ্নে দেখা মন্দিরটা। ফুলঠাম্মির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল ও। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ফুলঠাম্মিও বুঝতে পারলেন এটা সেই মন্দির! 

উনি আসতে করে ওর হাতে একটা চাপ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে উনি বুঝেছেন। অনুষ্কা ওনার দিকে তাকাতেই উনি চোখের ইশারা করলেন, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। 

অনুষ্কা  সেটা জানে। হঠাৎ ওর চোখে পড়লো পিছনের জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভরত। ও ওরকম লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? ওর অবাক লাগলেও ও দুই ঠাম্মিকে কিছু বলল না, বেকার নার্ভাস হয়ে পড়বে হয়তো। 

মন্দিরের পাশের পাঁচিল ইত্যাদি ভেঙে গেলেও মন্দিরটা প্রায় অক্ষতই আছে। গোটা ছয়েক সিঁড়ি উঠে মন্দিরের দরজা। কাঠের দরজা পিতলের পাত দিয়ে মোড়া। রঙ চটে গেলেও এখনও সম্পূর্ণ অক্ষত। দরজায় একটা বিরাট তালা লাগানো আছে। সেই তালার ওপর একটা সাপের নক্সা আঁকা। তালার ওপর বেশ কয়েকটা লাল সুতো আর কাপড় বাঁধা। মন্দিরের গায়ে অপূর্ব কারুকাজ। কিন্তু কোনও জানালা বা ঘুলঘুলি নেই। 

“এই সুতোগুলো কে বেঁধেছে?” জিজ্ঞাসা করলো অনুষ্কা।

“ হবে আশপাশের গ্রামের লোক। যদিও এই মন্দিরে পুজো হয় না কিন্তু লোকে এই মন্দিরকে খুব মানে।“

অনুষ্কা  ঘুরে ঘুরে ওর আই প্যাডটাতে মন্দিরের ছবি তুলছিল। মন্দিরের পিছন দিকটায় অনেক ভাঙা চোরা ঘর বাড়ী আছে। মনে হয় আগে এখানে মন্দিরের পুরোহিত বা সেবায়েতরা থাকতো। ও ছবি তুলতে তুলতে একটু দূরে চলে এসেছে। একটা ভাঙা দেয়ালের পিছন থেকে হঠাৎ একজন জটাধারী সাধু বেরিয়ে এলেন।

অনুষ্কা রীতিমত ঘাবড়ে গিয়েছিল। ওকে দেখতে পেয়েই সাধু ওকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন। অনুষ্কা মনে মনে ভাবছে লোকটা যদি ওর দিকে আসার চেষ্টা করে তাহলে ও ঘুরেই প্রাণপণ দৌড়বে। লোকটা বোধহয় ওর মনের কথা বুঝতে পেরেছিল। সে নিজের গলার পৈতেটা ধরে টেনে একটা জিনিষ বার করে তুলে ওকে দেখাল। ও দেখল একটা কারুকার্য করা বিরাট পুরনো দিনের চাবি। 

ওই চাবিটা ওর পরিচিত, হ্যাঁ এই চাবিটার ছবিই তো ও পুঁথিটাতে দেখেছে। এই লোকটার কাছে এলো কি করে চাবিটা? 

লোকটা চাবিটা পৈতে থেকে খুলে ওর দিকে ছুঁড়ে দিল। তারপর গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করলো-

ওঁ মহাদেবায় বিদ্মহে

রুদ্র মূর্তয়ে ধীমহি।

তন্নঃ  শিবঃ প্রচদয়াত্।।

তারপর হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। পায়ের কাছে পড়ে থাকা চাবিটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ দেখে অনুষ্কা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল।

অনুষ্কা মন্দিরের দিকে রওনা হতেই পাশের একটা ঝোপ থেকে ভরত বেরিয়ে এলো। 

“দিদি উও বাবাজি নে তুমকো ক্যা দিয়া?”

“ কিছু না।“ অনুষ্কার কেমন যেন মনে হল ভরত ওকে নজরে নজরে রাখছে, তাই ও সত্যি কথাটা বলল না। অনুষ্কা পা চালিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলো কিন্তু ভরত ছুটে ছুটে ওর সঙ্গে চলতে লাগলো। 

“ বোলো না। আভি তো তুমনে ব্যাগ মে রাখা।“

“ তোকে কেন বলব? আচ্ছা মুশকিল তো? ফুলঠাম্মি ... ও ফুলঠাম্মি !” অনুষ্কা দূরে ফুলঠাম্মিকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ডাকল। 

“ কোথায় গেছিলি? আমরা কখন থেকে খুঁজছি তোকে!”

ভরত একটু দূরে সরে গেলো ফুলঠাম্মিকে দেখে। 

“তাড়াতাড়ি চল ! বাড়ীতে সবাই নিশ্চয়ই চিন্তা করছে।“ 

ওরা সবাই যখন বাড়ীর দিকে রওনা হল তখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে।


(৮)

রাতে খাবার পর ঘরে ঢুকে অনুষ্কা বাবাকে মন্দিরের সাধুবাবার কথা বলল আর চাবিটা বার করে দেখাল। তারপর অধীরবাবু আর অনুষ্কা আই প্যাড খুলে চাবিটাকে ওই পুঁথির ছবির সাথে মিলিয়ে দেখল, একদম এক! 

“ কাল একবার তুই আর আমি সকাল সকাল ওই সাধুর সাথে দেখা করতে যাব বুঝলি?”

“ঠিক আছে।“ 

“ আর এ কথা যেন কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে!”

“ বাবা জানো, কাল আমরা যখন ওই মন্দিরটা দেখতে যাচ্ছিলাম, তখন ভরতকে দেখলাম ওই জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে। “

“ হুম! সেটা হয়তো কাকতালীয়। বা হয়তো নিছক কৌতূহল।“

অনুষ্কা আর কোনও কথা না বলে চুপ করে গেলো। 

পরেরদিন খুব ভোরবেলায়, তখনও দিনের আলো ফোটেনি অনুষ্কা আর অধীরবাবু চুপিচুপি, কাউকে কিছু না বলে রওনা হলেন সেই সাধুর সন্ধানে। আগের দিন যেখানে অনুষ্কা সাধুকে দেখেছিল সেখানে গিয়ে ওরা কাউকেই দেখতে পেলো না। তখন অনুষ্কার মনে পড়লো যে ওকে চাবিটা দেবার পর উনি জঙ্গলের দিকে হেঁটে চলে গিয়েছিলেন। 

“ বাবা আমরা একবার জঙ্গলের ভিতর গিয়ে দেখলে পারি না?”

“চল।“ বলে ওরা দুজন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যে সরু পথটা গেছে সেটা ধরে এগোতে লাগলো। 

জঙ্গলের ভিতর কিছুদূর যাবার পর ওরা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছল। সেখানে একটা গাছের নিচে একটা ছোট ঝুপড়ি দেখতে পেলো ওরা। যার সামনে আগুন জ্বালা হয়েছিল,  এখন প্রায় নিভে গেছে। কিন্তু এখনও সেটা থেকে অল্প অল্প ধোঁয়া বেরোচ্ছে।  এখন এখানে খুব ঠাণ্ডা। অনুষ্কা তাড়াতাড়ি আগুনটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অধীরবাবু ঝুপড়িটার ভিতরে উঁকি মারলেন। ভিতরে কেউ নেই। তারপর উনি অনুষ্কার কাছে এসে বললেন,” একটু দাঁড়িয়ে যাই বুঝলি। হয়ত কোথাও গেছেন। এসে পড়বেন।“

অনুষ্কা কাঁপতে কাঁপতে মাথা নেড়ে সায় দিল। 

কিছুক্ষণ বাদে বনের পথ দিয়ে সন্ন্যাসীকে আসতে দেখল ওরা। এই ঠাণ্ডায় একটা গেরুয়া ধুতি, লুঙ্গির মত করে পরা। মাথার চুল খোলা। কাঁধে একটা ভিজে গামছা, হাতে কমন্ডল। বোঝাই যাচ্ছে উনি স্নান করে এলেন। 

দূর থেকে ওদের দেখতে পেয়ে উনি একটু দাঁড়ালেন তারপর কাছে এসে বললেন,” আ গয়ি?  থোড়া রুক।“

উনি ঝুপড়ির ভিতর চলে গেলেন। ওনার হাব ভাব দেখে মনে হল যেন উনি ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। ওরা একটু অবাক হয়ে চুপচাপ বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। মিনিট পাঁচেক পরে উনি বেরিয়ে এলেন। মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, গায়ে একটা সুতির গেরুয়া চাদর। ওদের সামনের দুটো পাথর দেখিয়ে তার ওপর বসতে ইশারা করলেন। নিজে একটা চাটাইয়ের ওপর বসলেন। তারপর দুটো আখরোট বার করে ওদের হাতে দিলেন।

“ তোমার পিতাজি?” অধীর বাবুর দিকে ইশারা করে অনুষ্কাকে জিজ্ঞাসা করলেন উনি। 

অনুষ্কা  মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলাতে উনি বলতে শুরু করলেন, “মুঝে পাতা থা তোমরা আসবে। আমার  নাম সচ্চিদানন্দ মহারাজ । আমি কর্ণ প্রয়াগ থেকে এখানে তোমার জন্যই এসেছি। আমার গুরু আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। উনকো স্বপ্নে মে আদেশ মিলা।“

“ আপনি জানতেন আমি এখানে আসবো?” অবাক প্রশ্ন অনুষ্কার।

উনি একটু হাসলেন, তারপর সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। 

“ কিন্তু আপনি তো আমাকে চেনেন না, কখনো দেখেননি। আমি এ দেশে থাকিই না।“

“ মালুম হ্যায়। উপরওয়ালা  কখন কাকে দিয়ে কি কাজ করান...... উনকি লীলা উও হি জানে। আমাদের শুধু নিজেদের কাজ  করে যেতে হবে। আজ রাতে মন্দিরে এসো।  আজ এই মন্দিরের নাগপাশ খুলবো। কাজটা খুব গোপনে করতে হবে, আমার গুরুর সেরকমই আদেশ।“

“ আপনি আমাদের আসতে বলছেন কেন? আপনিই তো খুলতে পারেন।“ বললেন অধীর।

উনি মাথা নাড়লেন,” নাহি, আমি একা করতে পারব না। আপকি বেটি কো চুনা গয়া, এই কাজের জন্য। ঐ পুঁথিটা সেই দেখতে পায় যার ওপর এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ম্যায় সহায়ক হু।“

“ কি আছে ঐ মন্দিরের ভেতর।?”

“ গুরুর নিষেধ। আর কছু বলা যাবে না।“

সন্ন্যাসী নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ওরা বুঝল উনি আর কিছু বলতে চান না। ওরা দুজন রাত্রে খাবার পর আসবে কথা দিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা হল। 

ওরা খিড়কির দরজা দিয়ে বাড়ীর ভিতর ঢুকলো। অধীর বাবু এগিয়ে ঘরের দিকে চলে গেলেন।  অনুষ্কা  রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলো, খুব খিদে পেয়েছে। রান্নাঘরের সামনে ভরত কোথা থেকে এসে উপস্থিত হল। 

“ দিদি কাহাঁ  গয়ি থি?” 

“মন্দির দেখতে । কাল বাবা যায় নি তো তাই আজ গিয়েছিলাম। ”

“আচ্ছা। আচ্ছা দিদি, ওই পুঁথিটা তুমি কোথায় রেখেছ? “

“কেন রে?

“না এমনি । অত দামি কিতাব , তুমি নিশ্চয়ই সাবধানে রেখেছ?”

“ আজ নাস্তায় কি আছে রে?” অনুষ্কা কথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল। 

কিন্তু ভবি ভোলবার নয়, “ ঐ কিতাবটায় কি লেখা আছে? কোনো খাজানার নক্সা আছে কি?”

“ আচ্ছা মুশকিল তো! খাজানার নক্সা থাকবে কেন? যত সব আজগুবি চিন্তা ভাবনা।“ অনুষ্কা  ছুটে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

সকালের জলখাবার খাওয়ার পর ঘরের দরজা বন্ধ করে অনুষ্কা আর অধীর বাবু আই প্যাডটা নিয়ে বসলো। পুঁথির স্ক্যান করা পাতাগুলো খুলে দেখতে লাগলো। প্রথম পাতায় একটা শিবলিঙ্গের চারদিকে একটা পদ্ম ফুল আঁকা আছে। পরের পাতাগুলোতে যে ছবিগুলো আঁকা রয়েছে সেই ছবিগুলো ঐ মন্দিরের গায়েও খোদাই করা আছে। অনুষ্কা সব ছবি গুলো মনে মনে মুখস্থ  করে নিল। শেষ পাতায় সেই মন্ত্রটা লেখা-

ওঁ মহাদেবায় বিদ্মহে

রুদ্র মূর্তয়ে ধীমহি।

তন্নঃ  শিবঃ প্রচদয়াত্।।

অনুষ্কা ওর বাবাকে দেখাল, “ দেখো বাবা , এই মন্ত্রটা আমি জানি।“ বলে গড়গড় করে মন্ত্রটা বলে গেলো।

বাবা বললেন ,” শিব-গায়ত্রী মন্ত্র। তুই এটা জানলি কি করে?” 

অনুষ্কা অন্যমনস্ক ভাবে বলল,” আমি শুনেছি।“ 

এই সময়ে দরজাটায় টোকা পড়ল।  নতুন ঠাম্মি। উনি ঘরের ভিতর এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন তারপর চুপিচুপি বললেন,” ওই ভরত ছেলেটা তোমাদের কাছে কবে থেকে কাজ করছে ?”

“কেন বলুন তো?” অধীর জিজ্ঞাসা করলেন। 

“ না আমি এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখলাম ও তোমাদের দরজায় কান লাগিয়ে কিছু শুনছে।“ 

“আপনি চিন্তা করবেন না । আমরা সাবধানে থাকব।“ বললেন অধীর।

নতুন ঠাম্মি চলে যেতেই নীলিমা ঘরে ঢুকলেন। 

“ নতুন মাসীমা কেন এসেছিলেন?”

সব কথা শুনে উনি বললেন, “ কি জানি এই ভরতের হাবভাব আমারও একদম ভালো লাগেনা আজকাল।“ 

তারপর অধীর বাবু ওনাকে বললেন যে সন্ন্যাসী ওদের রাত্রে মন্দিরের সামনে ডেকেছেন ।

“ রাতে? কেন দিনে গেলে হয় না?”

“ আমি থাকব তো ! তুমি চিন্তা কোরো না।“

“ আমিও যাব।“

“অ্যাঁ!”

“হ্যাঁ। শোনো আমি দূরে দাঁড়িয়ে থাকবো। মন্দিরে ঢুকব না। ঐ সব সাধু সন্ন্যাসীদের বাবা ভয় করে। তুমি আর অনু যাবে । যদি কিছু গড়বড় দেখ তো আমায় একটা সিটি দিয়ে সিগনাল দেবে। আর আমি পুলিশে খবর দেবার ব্যবস্থা করব।“

“ অগত্যা।“ অধীর নিমরাজি হয়ে মাথা নাড়লেন।

“শোন আজ রাত জাগতে হবে তাই দুপুরে খাবার পর সবাই আমরা একটু ঘুমিয়ে নেব কেমন?” বললেন নীলিমা।

“ সেটা তুমি ঠিক বলেছ। কত রাত্তির হবে কে জানে?”

“ আর শোনো একটা করে শক্ত লাঠি আর টর্চ সঙ্গে নিয়ে নেব দুজনেই। কি জানি কখন কাজে লাগে?”

দুপুরে খাওয়ার পর ওরা সবাই ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। ঐ ঠাণ্ডায় রোদে দেওয়া লেপের তলায় শুতেই সকলের ঘুম এসে গেলো।

ঘুমের মধ্যে অনুষ্কা আবার সেই সন্ন্যাসীকে দেখল। উনি মন্দিরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার মুখে প্রসন্নতার হাসি। সন্ন্যাসী ওর সাথে কথা বলতে শুরু করলেন । উনি সংস্কৃততে কথা বলছেন কিন্তু অনুষ্কা পরিষ্কার বুঝতে পারছে। 

উনি বললেন , “ ত্রাহি মাম ( আমায় উদ্ধার কর )। “ 

তারপর উনি শিব-গায়ত্রী মন্ত্রটা  একটা অদ্ভুত সুরে গাইতে লাগলেন। ইশারায় অনুষ্কাকেও গাইতে বললেন। অনুষ্কা ওনার সঙ্গে গাইতে শুরু করলো। তারপর উনি মন্দিরের মধ্যে ঢুকলেন। অনুষ্কাও ওনার পিছনে পিছনে মন্দিরে ঢুকলো। উনি মন্দিরের মধ্যের একটা দেয়ালের সামনে দাঁড়ালেন তারপর মন্ত্রটা একটা বিশেষ সুরে গাইতে গাইতে দেয়ালের একটা জায়গায় চাপ দিলেন। দেয়ালটা সরে গেলো। আর একটা চাবি বেরিয়ে এলো। উনি সেই চাবিটা নিয়ে মাটিতে আঁকা পদ্মের উপর একটা গর্তে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর ওই মন্ত্রটাই অন্য একটা সুরে গাইতে গাইতে চাবিটা ঘোরাতে লাগলেন। সাতবার ক্লকওয়াইস, আর পাঁচবার অ্যান্টি-ক্লকওয়াইস। তারপর সারা মন্দির কাঁপতে লাগলো। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে ওর ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। 

মা ওকে ডাকছেন,” অনুষ্কা ! অনু অনু...। কি হয়েছে মা ?“ 

ওর মায়ের চেঁচামেচিতে বাবাও উঠে পড়েছেন। অনুষ্কা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গোঁ গোঁ করছিল। ওর মুখে চোখে জলে দিয়ে আলো জ্বালাতেই ওরা দেখে ওদের ঘরের সব জিনিষ ওলট পালট হয়ে রয়েছে।

দরজা হালকা করে ভেজানো রয়েছে। নীলিমা বললেন,” আমি তো দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলাম। আমার পরিষ্কার মনে আছে।“

অধীর বাবু সমস্ত জিনিষ খুঁজে দেখলেন। সবই আছে কেবল অনুষ্কার আই প্যাডটা কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। 

ফুলঠাম্মি, নতুনঠাম্মি দুজনেই ছুটে এলেন। 

“তোমরা দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলে তো?” জিজ্ঞাসা করলেন ফুলঠাম্মি।

“ হ্যাঁ মাসীমা।“ বললেন নীলিমা।

“আসলে এই ঘরের ছিটকিনিটা একটু ঢিলে হয়ে গিয়েছিল। সারাচ্ছি সারাবো করে আর সারানো হয়নি। এই ঘরগুলো তো খালি পড়ে থাকে তাই আর...।“ অপরাধীর মতন বলে উঠলেন নতুন ঠাম্মি।

“ আরে আপনি এতো কিন্তু করছেন কেন? আমি ভরত আর শঙ্করকে ডেকে জিজ্ঞাসা করছি।“ বললেন অধীর।

কিন্তু ভরত আর শঙ্করকে বাড়ীতে পাওয়া গেলো না। অধীর সবে ভাবছেন পুলিশের কাছে যাবেন, এমন সময় দুজনেই ঢুকলো বাড়ীতে। ওদের জিজ্ঞাসা করা হলে ওরা বলল যে দুপুরবেলা খাবার পর ওরা দুজন গ্রাম দেখতে গিয়েছিল। তাই ওরা কিছুই জানে না। 

অনুষ্কার মন খুব খারাপ হয়ে গেল, আই প্যাডটা ওর বড্ড প্রিয় ছিল । 

পর্ব ৫

(৯)

 রাত্রে খাবার পর অধীর বাবু ওনার ফুল মাসীমাকে বললেন, “ আমরা ডিনারের পর একটু হাঁটতে বেরবো। ঘরে চাবি দিয়ে যাবো। তুমি চিন্তা কোরো না।“

“ বেশী রাত্তির করিস না যেন। আর খুব ভালো করে গরম জামা পরে বেরোস। এখানকার ঠাণ্ডায় তোদের অভ্যাস নেই।“ বললেন উনি।

রাত্রে খাবার পর ওরা তিনজন বেড়ানোর ছলে বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরোল। তারপর পাড়ার মোড় থেকে ডানহাতে ঘুরে গিয়ে মন্দিরের দিকে চলতে শুরু করল। মন্দিরের কাছাকাছি এসে নীলিমা দেবী একটা ঝোপ মত গাছের পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন। এখান থেকে মন্দিরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আকাশে অষ্টমীর চাঁদ। জ্যোৎস্নায় চারিদিক মোটামুটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।   

অনুষ্কা আর অধীর বাবু মন্দিরের কাছে পৌঁছে দেখল সচ্চিদানন্দ মহারাজ ওদের জন্য মন্দিরের সামনে অপেক্ষা করছেন। সিঁড়ি বেয়ে ওরা সবাই মন্দিরের চাতালে উঠলো। মন্দিরের দরজার বড় তালাটার ওপরের কাপড় আর সুতোগুলো ছিঁড়ে ফেললেন উনি। তারপর মন্ত্র পড়তে পড়তে উনি মন্দিরটিকে তিনবার পরিক্রমা করলেন আর ওনার কমন্ডল থেকে চারিদিকে জল ছড়িয়ে দিলেন। তারপর অনুষ্কাকে বললেন ঐ চাবিটা দিয়ে তালাটা খুলতে। 

দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে উনি দেশলাই দিয়ে মন্দিরের মধ্যে একটা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালালেন। সেই আলোতে ওরা দেখলো প্রায় কুড়ি ফুট বাই কুড়ি ফুটের একটা ঘর। বহুদিন বন্ধ থাকার দরুন ঘরটা থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ বেরোচ্ছে। কিন্তু ঘরটা বেশ পরিষ্কার। অনুষ্কা  ভেবেছিল অনেক মাকড়শার ঝুল বা ধুলো হবে । বোধহয় কোন জানালা নেই বলে বাইরের ধুলো ময়লা ভিতরে ঢুকতে পারেনি। ঘরটার মাঝে একটা কালো পাথরের শিবলিঙ্গ । শিবলিঙ্গের চারদিকে মেঝের পাথরের বেদীর উপর একটা বিরাট পদ্ম ফুল খোদাই করা রয়েছে, যেমন ঐ পুঁথিতে আঁকা ছিল। 

অনুষ্কা ভালো করে ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। লিঙ্গের ডান দিকের দেয়ালে একটা ছবিতে ওর চোখ আটকে গেলো। ওর স্বপ্নে, এই ছবিটাতেই চাপ দিয়ে ছিলেন সেই সন্ন্যাসী , যার তলা থেকে বেরিয়েছিল একটা চাবি। ও ঐ দেয়ালটায় চাপ দিতে লাগলো। কিন্তু কোন ফল হল না। তারপর ওর মনে পড়ল উনি মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে চাপ দিচ্ছিলেন। অনুষ্কা একটু থেমে সুরটা মনে করল, তারপর মন্ত্রটা ঐ সুরে গাইতে গাইতে যেই চাপ দিল দেয়ালটাতে, সেটা ঘড়ঘড় শব্দ করে সরে গেলো। দেখা গেল দেয়ালের পিছনে একটা পেরেক থেকে ঝুলছে একটা চাবিটা। 

“ এখানে চাবিটা আছে তুই জানলি কি করে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন অধীর বাবু।

“ স্বপ্নে দেখেছিলাম।“ বলল অনুষ্কা । 

“ জয় শিব শম্ভু ! তেরা মহিমা অপার ।“ বলতে বলতে সচ্চিদানন্দ মহারাজ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন শিব লিঙ্গকে।

এবার অনুষ্কাকে চাবিটাকে পদ্মফুলের মধ্যের একটা গর্তে ঢোকাতে হবে। চাবিটা নিয়ে ও পদ্ম ফুলের সামনে যেতেই ঘটলো একটা সাঙ্ঘাতিক ঘটনা। 

দড়াম করে মন্দিরের সামনের দরজাটা খুলে গেলো। মন্দিরের ভিতরে ঢোকার পর আর ওদের দরজাটা বন্ধ করার কথা খেয়াল ছিল না। সেই দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে এলো শঙ্কর আর আরও তিনজন গুন্ডামত লোক, সঙ্গে নীলিমা। শঙ্কর  নীলিমার গলায় একটা ছুরি ধরে আছে । এদের সবাই সশস্ত্র। একজন তার হাতের বন্দুকটা অনুষ্কার দিকে তাক করে রেখেছে। 

ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা হতবাক। অনুষ্কা ভয়ে কাঁপছে। অধীর বাবু আর সচ্চিদানন্দ মহারাজ হাত ওপরে করে দাঁড়ালেন। 

“ ইয়ে খাজানা হামে ভি চাহিয়ে।“ চেঁচিয়ে উঠলো শঙ্কর।

সচ্চিদানন্দ হতচকিত হয়ে বলে উঠলেন,”খাজানা? কউন সা খাজানা?”

শঙ্করের পিছনের গুন্ডা মত লোকটা এগিয়ে এসে মারল ওনার মুখে এক ঘুষি। উনি টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেলেন।

অধীর শান্ত গলায় বললেন ,” ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমরাই  নিও খাজানা। কিন্তু কারুর কোন ক্ষতি কোরো না। “ 

“ নিকাল খাজানা!” চেঁচিয়ে উঠলো শঙ্কর। 

অনুষ্কা ওর বাবার দিকে তাকালও। উনি ইশারায় ওকে বললেন চাবি ঘোরাতে। অনুষ্কা  কাঁপা কাঁপা গলায় আবার মন্ত্র পড়তে পড়তে চাবিটাকে ঘোরাতে শুরু করলো। সাতবার clockwise  আর পাঁচবার anticlockwise  ঘোরানোর পর ঘড়ঘড় শব্দ করে শিবলিঙ্গের পিছনের দেয়ালটা  সরে গিয়ে ভিতর থেকে একটা সিঁড়ি বেরিয়ে এলো। 

সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্কা ছুটে ওর বাবার পিছনে গিয়ে লুকলো। ইতিমধ্যে সচ্চিদানন্দও উঠে দাঁড়িয়েছেন। অধীর বাবু বললেন, “ নাও দরজা খুলে গেছে। তোমরা যাও নিচে যা আছে তোমরা নিয়ে নাও, আর আমাদের ছেড়ে দাও।“

শঙ্কর নীলিমার গলার থেকে ছুরিটা একটুও না সরিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,” না না না। ইতনি জলদি নহি। তোমরা নিচে যাও। লল্লন অউর ছুট্টন ভাইয়া তোমাদের সঙ্গে যাবে ।“ 

উপায় না দেখে প্রথমে সচ্চিদানন্দজী তারপর অধীরবাবু আর অনুষ্কা, শেষে লল্লন আর ছুট্টন সিঁড়ি দিয়ে নিচে  নামলো। অধীরের টর্চের আলোয় দেখা গেল নিচে একটা ছোট ঘর। দশ ফুট বাই দশ ফুট হবে। ঘরের মাঝে একটা বেদি। আর সেই বেদির উপর একটি কাঠের বাক্স রাখা রয়েছে। আর সারা ঘরে কিছুই নেই। ওপরের মন্দিরের মতই এই ঘরটাও খুব পরিষ্কার।  একটা হাল্কা কর্পূরের মত গন্ধ পাওয়া গেল। মনে হয় এই ঘরটায় কোন আয়ুর্বেদিক ওষুধ দেওয়া ছিল যার জন্য কোন পোকামাকড় নেই। 

এই ঘরের কোনেও একটা ঘিয়ের প্রদীপ রাখা ছিল। সচ্চিদানন্দজী সেটা দেশলাই দিয়ে জ্বালালেন। তারপর উনি মন্ত্র পাঠ করতে করতে সেই বেদীটিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করলেন আর তার চারিদিকে নিজের কমন্ডল থেকে জল ছেটালেন। তারপর ধীরে ধীরে সেই বাক্সটা খুলে ফেললেন। 

লল্লন আর ছুট্টন হুমড়ি খেয়ে পড়লো বাক্সটার ওপর। দেখা গেলো ওর ভিতরে  কাপড় দিয়ে মোড়া একটি মানুষের দেহ রয়েছে। কাপড়টা সরাতে দেখা গেলো একজন যোগী পদ্মাসনে বসে আছেন। তার মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, পরনে গেরুয়া ধুতি। ওনার চোখ বন্ধ। শরীরে প্রাণের কোন স্পন্দন নেই । দেখে মনে হয় উনি চোখ বুজে ঘুমোচ্ছেন।  

“লাশ লাশ!” বলে চেঁচিয়ে ওরা দুজন ছিটকে সরে গেল।

ওরা সরে যেতেই অনুষ্কা ওনাকে দেখতে পেলো।  দেখেই ও চমকে উঠলো , আরে! ইনি তো সেই সন্ন্যাসী যাকে ও স্বপ্নে দেখে প্রায়ই!

“ মৃত্যুঞ্জয় মহারাজ! আপ কা কাহানী সচ হ্যাঁয়? জয় হো ! জয় হো! “ বলে সাষ্টাঙ্গে ওনাকে প্রণাম করলেন  সচ্চিদানন্দ মহারাজ । তারপর সচ্চিদানন্দ মহারাজ আর অধীর বাবু মিলে ঐ সন্ন্যাসীর শরীরটাকে বাক্স থেকে বার করে বেদীর ওপর বসিয়ে দিলেন। 

অধীর বাবু কাছে গিয়ে ওনাকে স্পর্শ করলেন। শরীর একেবারে ঠাণ্ডা। নাড়ি খোঁজার চেষ্টা করে দেখলেন, শরীরে প্রাণের কোন স্পন্দন নেই। কিন্তু ত্বক নরম। জীবন্ত মানুষের মত।

“ থোড়া গরম পানি লাগবে।“ বললেন সচ্চিদানন্দ।

“ গরম পানি কি হবে?” চেঁচাল ছুট্টন ।

“ বাবাজিকে সমাধি থেকে জাগাতে হবে। ইনি আড়াই হাজার সাল পহলে সমাধি নিয়েছিলেন।  “

“ উও জিন্দা হ্যায়?”

“ হাঁ। একটু সাহায্য করুন । ইনি সিদ্ধ পুরুষ। তারপর ওনাকেই জিজ্ঞাসা করে নেবেন খাজানে কা রাস্তা। শুনেছি কামাল কে শক্তিয়া ছিল ওনার।“

একটু অবিশ্বাসের সঙ্গে তাকালো ছুট্টন , তারপর ওর অন্য সঙ্গীকে বলল,”মানোহর যা তো কুছু কাঠ আর একটু জল নিয়ে আয়।“

“মন্দিরের বাইরে একটা বস্তায় আমি সব রেখে এসেছি।সঙ্গে এক ঘড়ে মে জলও আছে।“ বললেন সচ্চিদানন্দ।

মনোহর গিয়ে সেই বস্তাটা আর ঘড়া ভর্তি জল নিয়ে এলো।  

সচ্চিদানন্দ একটু আগুন জ্বেলে তার ওপর একটি হাঁড়িতে জল গরম করতে বসালেন। জল গরম হলে সেই গরম জল দিয়ে উনি স্নান করিয়ে দিলেন মৃত্যুঞ্জয় মহারাজকে। তারপর একটা ঘিয়ের ছোট পাত্র বার করলেন । সেই পাত্রের থেকে ঘি নিয়ে ওনার হাতে পায়ে মাখিয়ে দিতে লাগলেন। তারপর ধীরে ধীরে ওনার হাত আর পা টেনে টেনে সোজা করে ওনাকে বেদীর ওপর শুইয়ে দিলেন। 

ওনার বন্ধ চোখের পাতায়ও ঘি লাগিয়ে হাল্কা মালিশ করে দিলেন। তারপর ওনার কান আর নাকের থেকে মোমের তৈরি ছিপির মতন কতগুলো জিনিষ টেনে টেনে বার করলেন। তারপর ওনার মুখটা খুলে আঙ্গুল দিয়ে ওনার জিভটা টেনে বার করলেন। জিভটা গুটিয়ে আবার ভিতরে ঢুকে গেলো। তিন চারবার টেনে টেনে জিভটা সোজা করে তার ওপর খানিকটা ঘি লাগিয়ে দিলেন। 

লল্লন আর ছুট্টন বেশ বিরক্ত। আধ ঘণ্টার ওপর হয়ে গেছে। সচ্চিদানন্দ মহারাজ ঘি ঘষেই চলেছেন, কোন ফল হচ্ছে না।

“ অউর কতক্ষণ লাগবে?”

সচ্চিদানন্দ কোন উত্তর না দিয়ে নিজের কাজ করে চললেন।

অনুষ্কার কি মনে হতে ওনার কাছে গিয়ে ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। উনি চোখ মেলে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসলেন।

লল্লন আর মনোহর ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। অধীর স্তব্ধ হয়ে রইলেন। একটু আগেও উনি ওনার নাড়ি দেখেছেন , পাননি । 

লল্লন, মনোহরের চিৎকার শুনে শঙ্কর নীলিমাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলো। এসে সেও অবাক। 

সন্ন্যাসী স্মিত হেসে সংস্কৃততে অনুষ্কাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ কস্ত্বম্ (কে তুমি) ?”

“ আমি অনুষ্কা ।”

“ তুমি আমাকে জাগিয়ে আমার খুব উপকার  করেছ। তুমি কি চাও বল?“ মৃত্যুঞ্জয় মহারাজ সংস্কৃততে বললেন।

আশ্চর্য  ভাবে ওনার সব কথা অনুষ্কা বুঝতে পারছিল। ও বলল,” আমার কিছু চাই না।“

কিন্তু শঙ্কর চিৎকার করে উঠলো, “ পয়সে মাং নাহি তো তেরি মম্মি গয়ি।“ 

বিরক্ত হয়ে সন্ন্যাসী একবার ওর দিকে তাকালেন আর সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করের হাত পা অবশ হয়ে গেলো। নীলিমা দেবীকে ছেড়ে ও মাটিতে পড়ে গেলো, হাত থেকে ছুরিটা ছিটকে পড়ল দূরে।  ওকে দেখে লল্লন আর ছুট্টন ছুটে সন্ন্যাসীর দিকে এগোতেই ওদেরও একই দশা হল। এই সব দেখে মনোহর ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাইরে পালিয়ে গেল। 

অধীরবাবু আর নীলিমাদেবী ওনাকে প্রণাম করতেই উনি বলে উঠলেন,” সুখিস্তম্‌ । আমায় বাইরে নিয়ে চল।“ ওনার গলার স্বর অত্যন্ত দুর্বল।

সচ্চিদানন্দ মহারাজের কাঁধে ভর দিয়ে উনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওপরের মন্দিরে পৌঁছলেন। সেখানে শিবলিঙ্গকে প্রণাম করে বাইরের চাতালে এসে বসলেন।

তারপর সচ্চিদানন্দ মহারাজকে জানালেন  যে ওনার খিদে পেয়েছে। উনি ফলাহার করতে চান। সচ্চিদানন্দ মহারাজ সেই কথা অধীর বাবুকে জানাতে উনি বললেন,“ নিশ্চয়ই!” 

তারপর সচ্চিদানন্দ মহারাজকে সঙ্গে নিয়ে একটা রিক্সা ডাকতে গেলেন অধীরবাবু। সন্ন্যাসীর যা শরীরের অবস্থা এখন ওনার পক্ষে বাড়ী অবধি হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। যাবার আগে ওনারা মন্দিরের দরজাটা আবার আগের মত বন্ধ করে দিলেন যাতে কেউ জানতে না পারে যে মন্দিরের দরজা খোলা হয়েছে। 

অনুষ্কা আর নীলিমা দেবী মৃত্যুঞ্জয় মহারাজের সঙ্গে মন্দিরের চাতালে বসে রইল। এখন ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজে। চারিদিক অন্ধকার। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ভোরের আলো ফুটবে। 

বেশ খানিকক্ষণ পরে একজন রিক্সাওয়ালার ঘুম ভাঙ্গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে এলেন অধীরবাবুরা।  সন্ন্যাসীকে নিয়ে যখন ওরা বাড়ী পৌঁছল তখনও সূর্যোদয় হয়নি। 

ফুলঠাম্মি আর নতুনঠাম্মি ওদের কথাবার্তার আওয়াজে বাইরে এসে সন্ন্যাসীকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। 

“ এখন কোন প্রশ্ন কোরো না। আগে এনাকে ভিতরে নিয়ে যাই।“ বললেন অধীরবাবু। 

ওনাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসানো হল। নতুন ঠাম্মি ওনার জন্য এক  গ্লাস নুন-চিনির সরবত বানিয়ে এনে দিলেন। সেটা খেয়ে উনি অনেকটা সুস্থ হলেন। ওনার জন্য নতুন কাপড়ের আর ফলাহারের বন্দোবস্ত করা হল। 

অধীরবাবু বাড়ীর সবাইকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন আর এও বললেন, যে এক্ষুনি বাইরের সবাইকে এসব কথা জানানোর দরকার নেই। কারণ জানলে সারা গ্রামের লোক এসে জড়ো হবে। সেই ভিড় সামলানো আরেক মুশকিল। দুই ঠাম্মিই ওনার কথায় সম্মতি জানালেন।

ঘণ্টা খানেক বাদে নতুন কাপড় পরে, পূজা আর ফলাহারের পর উনি যখন এসে বাইরের ঘরে বসলেন, তখন ওনাকে অনেক সুস্থ মনে হল।  তখন ফুলঠাম্মি আর নতুনঠাম্মি ওনাকে প্রণাম করে  ওনার আশীর্বাদ নিলেন। উনি অনুষ্কার কাছে জানতে চাইলেন ওর কি চাই।

“ সন্তোষ কাকু যেন আবার চলতে পারে।“

উনি স্মিত হাসলেন।

“ আর এই গ্রামে জল নেই। যদি জলের ব্যবস্থা করতে পারেন তো গ্রামবাসীরা ...।“

উনি বললেন “তথাস্তু!” 

তারপর অনুষ্কাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। 

অনুষ্কা ওনার কাছে গেলে উনি ওর কপালের মাঝখানে ওনার ডান হাতের অনামিকাটা ঠেকিয়ে খানিকক্ষণ চোখ বুজে ধ্যান করলেন। তারপর সংস্কৃততে বললেন,” এই নে আমি তোকে তৃতীয় চক্ষু দিলাম। তুই এমন সব জিনিষ দেখতে পাবি যা অন্য কেউ দেখতে পায় না। তোর জীবনটাই বদলে যাবে। “

এবার উনি সচ্চিদানন্দ মহারাজের দিকে তাকালেন। সচ্চিদানন্দ ওনার পায়ের কাছে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন। উনি সচ্চিদানন্দের মাথায় হাত রেখে সস্নেহে বলে উঠলেন,” তুই তো আমার বেটা। এখন তোর অনেক কাজ । আমি তোকে সঙ্গে নিয়ে যাবো।“

সচ্চিদানন্দের ওনার পায়ের ওপর মাথা রেখে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। 

অনুষ্কা ওনাকে নিয়ে এ বাড়ীর শুকনো কুয়োটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এই এলাকায় জলের খুবই সমস্যায়। কারণ ভূমির জলস্তর অনেক নীচে চলে গেছে। তাই এলাকার সব কুয়োই শুকিয়ে গেছে। চাষবাসও বিশেষ হয়না। উনি ওনার পরনের কাপড়ের একটি টুকরো ছিঁড়ে সেটা কুয়োর মধ্যে ফেলে দিলেন। কিছুক্ষন বাদে কুয়োর তলা থেকে শো শো শব্দ হতে লাগলো। দেখতে দেখতে কুয়োটা ভরে গেলো জলে। 

“ আপনি এটা কেমন করে করলেন?” সবাই গদ্গদ।

” আমি করিনি শিবজী করেছেন। “ স্মিত হেসে বললেন উনি। 

তারপর উনি গেলেন সন্তোষকে দেখতে। ঘরে ঢুকে উনি ওর মাথায়ে গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,” বেটা ওঠার চেষ্টা কর।“ 

সবাইকে অবাক করে দিয়ে সন্তোষ উঠে বসলেন। নতুনঠাম্মি  আর থাকতে না পেরে ওনার পা জড়িয়ে ধরলেন। সবাই ওনাকে ঘিরে বসলো। ওনার কথা সবাই জানতে চায়। উনি যা বললেন তার সারমর্ম হল - 

বহু বছর আগে উনি এই মন্দিরে এসেছিলেন ওনার ভক্তদের সঙ্গে। এখানেই উনি মহেশ্বরের  স্বপ্নাদেশ পান যে ওনাকে সমাধি নিয়ে থাকতে হবে। অনেক দিন পরে ওনাকে একটা কাজ করতে হবে। যখন সেই কাজের সময় আসবে প্রভু ওনার সমাধি ভঙ্গ করার জন্য কাউকে পাঠিয়ে দেবেন। এরপর উনি ওনার আশ্রমের দায়িত্ব ওনার শিষ্যদের ওপর দিয়ে নিজে সমাধি নেবার জন্য প্রস্তুত হলেন। ওনার সুরক্ষার জন্য দুটি পুঁথি লেখা হয়। ওনাকে জাগানোর প্রক্রিয়া একটা পুঁথিতে লিখে সেটা ওনার আশ্রমে লুকিয়ে রাখা হয়। আর ঠিক হয় যে, ঐ আশ্রমের কর্ণধার যে হবে তাকে ঐ পুথিটির দায়িত্ব দেওয়া হবে । আশ্রমের আর কেউ ঐ পুঁথি সম্বন্ধে কিছু জানবে না। আর তার ওপরেই ওই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বও  দেওয়া হবে। 

অন্য পুঁথিটিতে লেখা হয় এই মন্দিরের গোপন প্রকোষ্ঠ খোলার প্রক্রিয়া। সেই পুঁথিটি দেওয়া হয় ওনার ভক্তকে । ওনার ভক্ত কথা দেন যে ওদের পরিবারের উত্তর পুরুষরা  রক্ষা করবে এই পুঁথি। কিন্তু গার্হস্থ্য জীবনে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা খুবই শক্ত। তার ওপর ঐ পুঁথিতে কি লেখা আছে তাও খুলে বলা হয় নি ওনাদের। এই মন্দিরের তলায় যে এই প্রকোষ্ঠ ছিল সেটাও ওনার ভক্ত জানতো না। তারপর ওনার পার্থিব শরীরকে লুকিয়ে রাখা হল ঐ প্রকোষ্ঠে, সবার চোখের আড়ালে। উনি সমাধিতে লীন হয়ে যাবার পর ওনার ভক্তরা এই মন্দিরকে নাগপাশ দিয়ে বেঁধে  একেবারে বন্ধ করে দেয়, যাতে কেউ ওনার সন্ধান না পায়।  আর এও রটিয়ে দেওয়া হয় যে কেউ যদি জবরদস্তি এই মন্দিরে ঢোকার চেষ্টা করে তাহলে তার মৃত্যু হবে। 

এখন ওনারা যাবেন কুম্ভমেলাতে। ওখানে মৌনী অমাবস্যার দিন শাহী স্নান করে ওনারা চলে যাবেন হিমালয়ে। জ্যৈষ্ঠ মাসের আগে ওনাকে কেদারনাথ মন্দিরে পৌছতে হবে। 

স্বপাক আহার করে বেলা চারটে নাগাদ উনি বললেন,” এবার আমায় যেতে হবে। “

ইতিমধ্যে সচ্চিদানন্দ মহারাজ ওনার ডেরার থেকে নিজের যৎসামান্য জিনিষপত্র একটা ছোট পুটলি করে নিয়ে চলে এসেছেন। 

যাবার আগে উনি অনুষ্কাকে ডেকে বললেন যারা মন্দিরের নিচের ঘরে পড়ে আছে, তাদের গায়ে ও হাত ছোঁয়ালেই তারা আবার স্বাভাবিক হবে।

বিকেলের পড়ন্ত রোদে দুইজন সন্ন্যাসী দৃপ্ত পদক্ষেপে রওনা হলেন প্রয়াগের উদ্দেশ্যে।  


(১০)

সন্তোষ আর আধীরবাবু গেলেন লোকাল পুলিশ থানায় খবর দিতে। এতো বছর বাদে নিজের পায়ে হেঁটে বাড়ির বাইরে বেরোতে পেরে সন্তোষ এতো খুশি যে কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। থানাতে সবাই সন্তোষকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। অধীরবাবু পুলিশ স্টেশনে সব ঘটনা জানালেন, শুধু মৃত্যুঞ্জয় মহারাজের কথাটা এড়িয়ে গেলেন। বললেন যে, একজন সাধু এসেছিলেন মন্দিরের নাগপাশ খোলার জন্য, উনিই সন্তোষের পা ঠিক করে দিয়েছেন। ওরা মন্দিরের দরজা খুলতেই একদল গুণ্ডা ওদের আক্রমন করে। গুণ্ডাদের মন্দিরের  নিচের ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। 

থানার ইন্সপেক্টর ওনাদের সঙ্গেই এলেন। তারপর কনস্টেবলরা মন্দিরের নিচের ঘরে গিয়ে শঙ্কর, ছুট্‌টন আর লল্লনকে টেনে বার করে আনল। ওদের মন্দিরের সামনের চাতালে শুইয়ে দেওয়া হল। 

“ইন লোগণ কা ইয়ে হাল কিসনে কিয়া?” জিজ্ঞাসা করলেন ইন্সপেক্টর সাহেব। 

“কি হয়েছে দেখি! “ বলে অনুষ্কা ওদের শরীরে হাত ছোঁয়াতেই  ওদের শরীরের সাড় ফিরে এলো। 

পুলিশ শঙ্করকে দু এক ঘা লাগাতেই ও গড়গড় করে যা বলল তা এরকম -  

ভরত বাড়ী গিয়ে ওর বাবা , দাদা সকলের কাছে অনুষ্কার ওই পুঁথিটার গল্প করে। আর এও বলে যে মিশ্রা চাচা বলেছে ওই কিতাবটার অনেক দাম। ভরতের দাদা শঙ্কর বহুদিন ধরে ছুট্‌টনের গ্যাঙে ঢোকবার চেষ্টা করছিল। ছুট্‌টন পাত্তা দিচ্ছিল না। শঙ্কর এই পুঁথিটার খবর ছুট্‌টনকে দেয়।  ছুট্‌টন সব কথা শুনে ওকে পুঁথিটা চুরি করে আনতে বলে আর এও বলে যে ও যদি এই কাজটা ঠিক করে করতে পারে তাহলে ওকে নিজের গ্যাঙে নেবে। এই শুনে শঙ্কর ওই বইটা চুরি করার পরিকল্পনা বানায়। 

যেদিন অনুষ্কারা সঙ্গমে স্নান করতে গিয়েছিল সেদিন শঙ্কর সবার অলক্ষে এসে ওদের সুটকেসটা খোলার চেষ্টা করে । কিন্তু ওই নতুন ধরনের তালা মানে কম্বিনেশন লক সম্বন্ধে ও কিছু জানত না। তাই ও সেটা খুলতে পারেনি। পরের দিন ও অনুষ্কাদের অনুসরণ করার চেষ্টাও করে। ও মোটরবাইকে করে ওদের গাড়িটা অনুসরণ করছিল। দুর্ভাগ্যবশত সেদিন রাস্তায় ওর মোটরবাইকটা খারাপ হয়ে যাওয়ার  সেদিনও ও সফল হয়নি। এরপর ভরত জানায় যে ওরা দেশের বাড়ী যাচ্ছে। শঙ্কর সেই কথা ছুট্‌টনকে জানাতে ছুট্‌টন ওকে ভরতের সঙ্গে যেতে বলে। ছুট্‌টনও নিজের সাথীদের নিয়ে পরের বাসে রওনা হয়ে ওখানে পৌঁছয়। 

শঙ্কর পুঁথিটা চুরি করার শেষ চেষ্টা করে এই বাড়ীতে । কিন্তু  সব ব্যাগ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ও সেই পুঁথিটাকে খুঁজে পায় না। পরে ওর মনে পড়ে ভরত ওকে একবার বলেছিল যে দিদি ওই ছোট মেশিনটা থেকে বই পড়ে। হতে পারে ও কিতাবটা ওই মেশিনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। তাই ওরা অনুষ্কার আই প্যাডটা চুরি করে। কিন্তু কোন লাভ  হয় না । ওরা ওই মেশিনটা চালাতে জানেনা, তাই ওর ভিতর থেকে পুঁথিটাও ওরা বার করতে পারেনি।

এই কথা শুনে অনুষ্কা, অধীর, নীলিমা আর সন্তোষ সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে।  

হঠাৎ অনুষ্কা জিজ্ঞাসা করে,” ভরত কোথায়?” 

শঙ্কর বলল, “ ভরত আমাদের সাহায্য করতে রাজি হলনা। তাই ওর হাত মুখ বেঁধে বাড়ীর পিছনের দিকের একটা ঘরে বন্ধ করে রেখেছি।“  

পুলিশ সেখানে গিয়ে ভরতকে উদ্ধার করে আনল। বেচারা সারা রাত ওখানে বন্ধ থেকে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ছাড়া পেয়ে কেঁদে ফেলল,” আমি জানতাম না আমার দাদা এই রকম বদমায়েশ।“

নতুন ঠাম্মি ওকে হলুদ দেওয়া দুধ খেতে দিলেন। 

পুলিশ শঙ্করদের অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবার সময় ওদের জিনিষপত্রের মধ্যে অনুষ্কার আই প্যাডটা পাওয়া গেলো। 

সেদিন বিকালেই অনুষ্কারা এলাহাবাদ ফিরে এল। আসার আগে অনুষ্কা  ওর আই প্যাডটা সন্তোষ কাকুকে দিয়ে এলো। 

সেদিন ওদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাড়ীর দরজা খুললেন ফুল-দাদু। বললেন “আমার পায়ের ব্যথা একদম কমে গেছে। আমার মনে হচ্ছে আমার বয়স দশ বছর কমে গেছে।।“

“ উনি অন্তর্যামী ...... অন্তর্যামী। আমি যা চেয়েছিলাম উনি আমায় দিয়েছেন।“ ফুল-ঠাম্মি হাত জোড় করে মাথায় ঠেকালেন মৃত্যুঞ্জয় মহারাজের উদ্দেশ্যে । 

চা খেতে বসে ফুলঠাম্মি ফুল-দাদুকে সব কথা খুলে বললেন। 

“ এই পুঁথিটা নিয়ে কি করা যায়?” ফুলমেসোকে জিজ্ঞাসা করলেন অধীরবাবু ।

উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন ,” ওই পুঁথি অনুষ্কাদিদির। তাই দিদির যা ইচ্ছা তাই করতে পারে ওই পুঁথিটাকে নিয়ে । ওটা আমি দিদিকে দিলাম।“ 

পরেরদিন অনুষ্কা আর ওর বাবা গেলো নৈনীতে ডঃ সমীরের কাছে। পুঁথিটা নিয়ে বাড়ী ফেরার পথে ট্যাক্সিতে অধীরবাবু অনুষ্কাকে জিজ্ঞাসা করলেন ,” অনু তুই এই পুঁথিটা নিয়ে কি করতে চাস? “

“ওটা পুরাতত্ব বিভাগে দিয়ে দাও বাবা। ওটা দেশের সম্পত্তি।“ বলে উঠলো অনুষ্কা । 

অধীর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” I am proud of you beta.” 

অনুষ্কা দাঁড়িয়ে আছে কেদারনাথ মন্দিরের সামনে। সূর্য অস্ত গেছে বেশ খানিকক্ষণ। মন্দিরের সন্ধ্যারতি হয়ে গেছে। আশপাশের বাড়ী গুলোতে ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে আলো। মৃত্যুঞ্জয় মহারাজ বেরিয়ে এলেন মন্দিরের দরজা থেকে। বাইরের চাতালের ওপর রাখা নন্দীকে প্রণাম করে ধীর পদক্ষেপে নেমে এলেন মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে। এখন ভক্তদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। সবাই যে যার আশ্রয়ের দিকে রওনা হয়েছে। মহারাজ সিঁড়ি দিয়ে নেমে মন্দিরের পাশের রাস্তাটা দিয়ে মন্দিরের পিছন দিকে রওনা হলেন। কৌতূহলবশত অনুষ্কা ওনাকে অনুসরণ করতে লাগলো। উনি মন্দিরের পিছনের খোলা জমিটা পেরিয়ে ঢুকে গেলেন পাহাড়ের পাদদেশের জঙ্গলটার মধ্যে। অনুষ্কা ওখানে পৌঁছে দেখলো একটা বিশাল পাথরকে অনায়াসে গড়িয়ে নিয়ে আসছেন মৃত্যুঞ্জয় মহারাজ। পাথরের আকার এতই বড় যে তার সামনে ওনাকে পুতুলের মত দেখাচ্ছে। অনুষ্কা শুনেছিল যে উনি অসীম শক্তির অধিকারী আজ তার প্রমাণ পেল। পাথরটা কেদারনাথ মন্দিরের দিকে দুর্দান্ত গতিতে গড়িয়ে চলেছে । অনুষ্কা ভাবল নিশ্চয়ই পাথরটা গিয়ে ধাক্কা মেরে মন্দিরটাকে ভেঙ্গে দেবে। কিন্তু পাথরটা মন্দিরের ঠিক পিছিনে পৌঁছতেই ওটাকে থামিয়ে দিলেন মহারাজ। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন, “ আমার কাজ শেষ। কৈলাসম গচ্ছামি।“ 

তারপরেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর তখনই অনুষ্কার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। ঘুম থেকে উঠেও ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না যে ও স্বপ্ন দেখছিল। তাড়াতাড়ি উঠে ও বাবার কাছে ছুটল, ওর স্বপ্নের কথাটা বলতে। 

ওরা ভারত থেকে ফিরে এসেছে প্রায় পাঁচ মাস হল। অনুষ্কার স্কুলে গরমের ছুটি চলছে। প্রত্যেকদিনের মত আধীরবাবু অফিস থেকে ফিরে টিভিতে খবর দেখছিলেন । 

“বাবা জানো আমি না এক্ষুনি মৃত্যুঞ্জয় মহারাজকে……।“বলতে বলতে  ও টিভির দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। 

ওকে দেখে অধীর বাবু বললেন,” তুই এসেছিস! দ্যাখ কি কাণ্ড কেদারনাথে……।“ 

খবরে দেখাচ্ছে  কেদারনাথে ফ্ল্যাশ ফ্লাড হয়েছে। তাতে ওই এলাকার বাড়ী ঘর, হোটেল সব কিছু ভেসে গেছে। ১৬ই জুন ২০১৩, সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ চোরাবারি তাল থেকে হঠাৎ প্রচুর পরিমানে জল বইতে শুরু করে এবং পথে যা আসে সমস্ত কিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরের দিন, মানে ১৭ তারিখ ভোর ছটার সময় আবার প্রচুর পরিমানে জল সরস্বতী নদী আর চোরাবারি তাল থেকে প্রচণ্ড গতিতে বইতে শুরু করে। এবার জলের সঙ্গে আসে অনেক পাথরের টুকরো আর পলিমাটি । মন্দিরের দুই পাশের সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। মারা গেছে প্রায় দুশ মানুষ, আড়াই শ আহত, চার হাজার মানুষ নিরুদ্দেশ। দু হাজারের ওপর বাড়ী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তিন হাজার ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, প্রায় বারো হাজার বাড়ী আংশিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। 

কিন্তু আশ্চর্যভাবে মন্দির অক্ষত। প্রত্যক্ষ দর্শীরা বলেছেন একটা বিরাট পাথরের চাঁই কোথা থেকে এসে কেদারনাথ মন্দিরের পিছনে আটকে যায়। যেটা মন্দিরকে ঐ প্রচণ্ড জলের প্রকোপ থেকে রক্ষা করে।  জলের তোড়ে যে পাথরগুলো  ভেসে এসেছে সেগুলো আকারে অনেক ছোট। মন্দিরের পিছনে যে পাথরটা আটকেছে সেটা আকারে অনেক গুণ বড়। শ্রদ্ধালুরা এটাকে বাবা কেদারনাথের মহিমা মনে করছেন।

“ মহিমাই তো! জয় বাবা কেদারনাথ!” বলে উঠলেন নীলিমা। অনুষ্কা আর অধীরবাবু গলা মেলালেন।

                                             -সমাপ্ত-

Copyright © Boiraag Publication- বইরাগ পাবলিকেশন  - All Rights Reserved. 

  • e-Magazine
  • Contact Us
  • Publish With Us
  • About Us
  • Announcements